মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
সোমবার এক মাস হল আরজি কর-কাণ্ডে নির্যাতিতার মৃত্যুর। সেই দিনেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহ্বান, ‘‘এক মাস তো হয়ে গেল। আমি অনুরোধ করব, পুজোয় ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন।’’ এরই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আরও অনেক কথা বললেও বিরোধী দলের নেতারা আপাতত মমতার ওই বক্তব্যের সমালোচনায় সরব। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে কী মনে করেন? গোটা রাজ্যের মানুষ কি ওঁর দলের চাকরবাকর নাকি! উনি ঠিক করে দেবেন মানুষ কখন আন্দোলন শেষ করবে?’’ সেখানেই না থেমে সুকান্তের আরও বক্তব্য, ‘‘গোটা বাংলা ভারাক্রান্ত। জীবনে কখনও যে মা মিছিলে হাঁটেননি, তিনিও পথে। নির্যাতিতাকে সকলে কন্যা, মা, সহোদরা মনে করে আন্দোলনে নেমেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর উচিত সমব্যথী হয়ে রাজ্যের মানুষকে সমবেদনা জানানোর। তা না করে আন্দোলনকে ভয় পেয়ে তিনি মানুষকে পুজোর আনন্দে মাততে বলছেন! এটা নিন্দনীয়।’’ ওই মন্তব্যের পাল্টা আন্দোলন হবে বলেও জানিয়েছেন সুকান্ত।
প্রসঙ্গত, সোমবার সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার শুনানি শেষ হওয়ার পরে পরেই নবান্নে শুরু হয় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক পর্যালোচনা বৈঠক। সুপ্রিম কোর্ট সাধারণ আন্দোলনকারীদের কোনও নির্দেশ না দিলেও জুনিয়র চিকিৎসকদের কাজে যোগ দিতে বলেন মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই। দিনের পর দিন জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন ও কর্মবিরতির ফলে রাজ্য যে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে সমস্যায়, তা সুপ্রিম কোর্টেও সোমবার জানায় রাজ্য। এর পরেই প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ কর্মবিরতি শেষ করতে বলে। আর তাতেই শাসক শিবির ‘স্বস্তি’ দেখছে। মুখ্যমন্ত্রীও সোমবার ‘দৃঢ়’ অবস্থান নিয়েছেন বলেই মনে করছে প্রশাসনিক মহল। যে সব পুজো কমিটি রাজ্যের দেওয়া ‘দুর্গা ভান্ডার’ নেবে না বলে জানিয়েছে, তাদের গুরুত্ব না দেওয়ার বার্তাও দিয়েছেন।
এর পরেই আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ মমতা বলেছেন, ‘‘প্রতি দিন রাতে আপনারা যদি রাস্তায় থাকেন, অনেক মানুষের তো সমস্যা হয়। অনেক এলাকায় অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন। আলো লাগলে তাঁদের ঘুমের সমস্যা হয়।’’ তিনি যে এত দিন ধরে আন্দোলনকে ‘মেনে নিয়েছেন’, তা বুঝিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নিয়মও রয়েছে রাত ১০টার পরে মাইক বাজানো নিয়ে। তা সত্ত্বেও তো আমরা সব ছেড়ে দিয়েছি।’’ এর পরেই তিনি বলেন, ‘‘এক মাস তো হয়ে গেল। আমি অনুরোধ করব, পুজোয় ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন।’’
রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন রিমঝিম সিংহ। মমতার সোমবারের বক্তব্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘জনসাধারণ এখন মহোৎসবেই রয়েছেন। কারণ, আন্দোলনকেই তাঁরা মহোৎসব বলে মনে করছেন। তাঁরাই তো ঠিক করবেন কোনটা উৎসব।’’ একই সঙ্গে রিমঝিমের দাবি, ‘‘এই আন্দোলন তো এই একটি ঘটনার জন্য নয়। ভবিষ্যতেও যাতে এমন না ঘটে, সেই দাবিতেই মানুষ পথে নেমেছেন। আন্দোলন থেকে যে সব দাবি উঠেছে, তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত রাজ্য প্রসাশন কোনও পদক্ষেপ করেনি। তাই মানুষই ঠিক করবেন, কোন উৎসবকে বেছে নেবেন তাঁরা।’’
আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে পরবর্তী শুনানি। ঘটনাচক্রে, সেই মঙ্গলবার বিশ্বকর্মা পুজো। তখন থেকেই ফি বছর পুজোর ‘মুড’ চলে আসে বাংলায়। মহালয়া ২ অক্টোবর। তার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় ঠাকুর দেখা। কিন্তু সেই পুজোর আবহেই ঠিক এক মাস পরে নির্যাতিতার মৃত্যুর রাতের দু’মাস পূর্ণ হবে। এই সোমবারেই এক মাস পূর্ণ হওয়ার দিনে রাজ্যের অনেক জায়গায় রয়েছে আন্দোলন কর্মসূচি। কলকাতাতেও পথে নামার কথা আন্দোলনকারীদের। ফলে পুজোর দিনগুলিতেও আন্দোলনের ‘রূপ’ কেমন থাকবে, তা নিয়ে চিন্তায় প্রশাসন। অনেকে মনে করছেন রাজ্যে উৎসবের আবহ এলে আন্দোলনের ‘ঝাঁজ’ কিছুটা কমতে পারে। আবার অনেকের ধারণা, পুজোর সময়ে আন্দোলনের চেহারা বদলে যেতে পারে।
নবান্নের কর্তাদের একাংশ মনে করছেন, প্রশাসনের সেই সমস্যার কথা অনুমান করেই রাজ্যবাসীকে পুজো তথা উৎসবে ফিরতে আর্জি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে সেটাকে যে সহজে মেনে নিচ্ছেন না আন্দোলনকারীরা, তা বুঝিয়ে ‘বামপন্থী’ হিসাবে পরিচিত অভিনেত্রী উষসী চক্রবর্তী দাবি করেন, এ বার পুজোর মুড নেই কারও মনেই। নিজের কথা জানিয়ে উষসী বলেন, ‘‘পুজোর কিছু কিনিনি। কিনবও না। যেখানে নারীরা সুরক্ষিত নন, সেখানে পুজোর জামা কিনব কেন? যেখানে একটা মেয়ে মরে গেল, সেখানে অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করার জায়গাই নেই।’’
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে আরও কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘এই কথায় স্বৈরাচারীর স্বর রয়েছে। উৎসব তো হয় মনের আনন্দে। মনে আনন্দ থাকলে তবেই তো উৎসব। উনি তো মানুষের আনন্দটাই কেড়ে নিয়েছেন। তাই মানুষই মানুষের পথ ঠিক করবে।’’ শমীকের আরও দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর নিজের দলের নিচু তলার সমর্থকেরাও বিচারের দাবিতে পথে নেমেছেন। একই সুর সিপিএমের দীপ্সিতা ধরের। তিনি বলেন, ‘‘আন্দোলনকে ভয় পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর সেই ভয় থেকেই উৎসবের মুড আনতে চাইছেন। ভাবছেন, উৎসবের আলোয় অন্ধকার ঢেকে দেবেন। কিন্তু সেটা হবে না। যিনি পুজোয় থাকবেন, তিনি মিছিলেও হাঁটবেন।’’
পুজোর দিনগুলিতে বামেরা যে পথে থাকবে, তা আগেই জানানো হয়েছে। বিজেপির পক্ষে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, প্রতিটি বড় মণ্ডপের সামনে নারী নির্যাতনের বিচারের দাবিতে সই সংগ্রহ অভিযান চালাবে বিজেপি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy