দিদি কি দাদার হয়েই ব্যাট করলেন? না কি নিজের হয়ে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আইসিসিতে তাঁকে পাঠানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে প্রকাশ্যে অনুরোধ জানিয়ে কি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপকার করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? না কি রাজনীতির পিচে ব্যাট করতে নেমে ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সফল অধিনায়ককে ‘নন স্ট্রাইকার’ প্রান্তে রেখে নিজের রান বাড়িয়ে নিলেন?
সোমবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা প্রকাশ্যেই বলেছেন, সৌরভকে আইসিসিতে পাঠানোর জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদীকে বিনীত অনুরোধ করছেন। মমতা বলেন, ‘‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, দয়া করে সৌরভকে আইসিসির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হোক।’’
মমতার সেই অনুরোধে চিঁড়ে ভিজবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটা ঠিক যে, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোমবার বিকেলে তাঁর স্বীয় রাজনীতির একটি ‘মাস্ট্রারস্ট্রোক’ খেলেছেন। যে স্ট্রোকে এক ধাক্কায় চার-চারটি ছক্কা মেরেছেন তিনি। এক, সরাসরি এবং প্রকাশ্যে সৌরভের পাশে দাঁড়িয়ে মমতা তাঁকে ‘নিজের লোক’ বলে চিহ্নিত করে দিতে পেরেছেন। অর্থাৎ, সৌরভ যে কলকাতা এবং দিল্লির মধ্যে বরাবর একটা ভারসাম্য রেখে চলছিলেন, তা নস্যাৎ করে দিয়েছেন মমতা। দুই, এটা এখন আর অজানা নয় যে, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সৌরভকে মমতার ‘বিকল্প মুখ’ হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছিল বিজেপি। ভবিষ্যতের জন্য মমতা সেই সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট করেছেন। কারণ, সৌরভ এখন সরাসরিই ‘তাঁর লোক’ হিসাবে পরিচিত হয়ে গিয়েছেন। তিন, সৌরভকে সমর্থনের মাধ্যমে মমতা বাংলার ক্রিকেট প্রশাসনে তাঁর ‘প্রভাব’ আরও বাড়িয়েছেন। বস্তুত, জল্পনা হল, এর পরে মমতা তাঁর ‘আস্থাভাজন’ বিশ্ব মজুমদারকে সৌরভের শাসনাধীন সিএবি-তে মসৃণ ভাবে নিয়ে নেওয়াতে পারবেন। অবশ্যি বিশ্ব যদি ক্রিকেট প্রশাসনে যেতে রাজি থাকেন। চার, এটাই সবচেয়ে বড় লাভ— প্রকাশ্যে সৌরভের পাশে দাঁড়িয়ে মমতা বাংলা এবং বাঙালির আবেগকে আরও বেশি করে নিজের দিকে টেনে নিতে পেরেছেন।
এর ফলে সৌরভের লাভ হল কি হল না, তা সময় বলবে। কিন্তু উপস্থিত মমতার যে লাভ হয়েছে, তাতে কারও কোনও সন্দেহ নেই। রাজনীতির শিল্পকলায় প্রখর ধীশক্তিসম্পন্না তৃণমূল নেত্রী সৌরভকে নন স্ট্রাইকার প্রান্তে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজের এবং দলের রান যে হু-হু করে বাড়িয়ে নিয়েছেন, তা নিয়ে তাঁর বিরোধীরাও দ্বিমত নন। মমতার স্ট্রোকের ফুলঝুরিতে দৃশ্যত বিহ্বল বিজেপি দাবি তুলেছে, তা হলে কেন সৌরভকে বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর না করে শাহরুখ খানকে করা হয়েছিল! সিপিএম বলেছে, মমতা যেন দয়া করে সৌরভকে ছুঁয়ে তাঁর ১২টা না বাজান!
বস্তুত, ‘মহারাজ’ কার? রাজা বদলের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নের উত্তর বরাবর বদলেছে। ‘যখন যেমন, তখন তেমন’ মেজাজে একের পর এক ইনিংস খেলে গিয়েছেন সৌরভ ‘মহারাজ’ গঙ্গোপাধ্যায়। বাম আমলে রাজ্যের মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর যেমন ‘সখ্য’ ছিল, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যেমন তিনি ‘গুণমুগ্ধ’ ছিলেন, তৃণমূল জমানায় তেমনই বা আরও একটু বেশি তাঁর ঘনিষ্ঠতা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আবার মমতার ‘আস্থাভাজন’ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বাড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তিনি নিয়মিত অতিথি। ঘটনাচক্রে, এই সমীকরণ আবার বাংলার সীমান্ত পার হলেই বদলে গিয়েছে। দেশের রাজনীতিতে গেরুয়া উত্থানের পরে বিজেপির (পড়ুন অমিত শাহ) সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে সৌরভের।
নিন্দকেরা বলবেন ‘দু’নৌকায় পা’। কিন্তু তাঁর সমর্থকেরা বলবেন, এমনই সৌরভের ‘বৈগ্রহিক’ প্রভাব যে, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না নেমেও রাজনীতির প্রত্যক্ষ সমর্থন তিনি আদায় করে নিয়েছেন। একথা সকলেরই জানা যে, ক্রিকেট ছাড়ার পর সৌরভ সিএবি সভাপতি হয়েছিলেন দিদির আশীর্বাদে। আবার সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিসিসিআই সভাপতি হয়েছিলেন শাহী প্রভাবে। অর্থাৎ, ক্রিকেট প্রশাসনে তাঁর আগমন মমতার আশীর্বাদ পেয়ে। সেখান থেকে উত্থান অমিতের শুভেচ্ছায়। কালে কালে তাঁকে নিয়ে অনেক জল্পনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সৌরভ বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি কারও নন, তিনি ২২ গজের। তিনি ক্রিকেটের। খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পরে বিজ্ঞাপনের মডেল থেকে টিভির অনুষ্ঠানের সঞ্চালক কিংবা ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকার হিসাবে তাঁকে দেখা গিয়েছে। কিন্তু মহারাজ বুঝিয়েছেন, তিনি আসলে ক্রিকেটের রাজা হতে চান। তাঁর যাবতীয় উচ্চাশা ক্রিকেট প্রশাসনের রাজা হওয়ার। সেই মতো ভারসাম্য রেখে চলেছেন। তাঁর বাড়িতে যেমন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে এনে নৈশভোজ করিয়েছেন, তেমনই তার মেনুতে ‘দিদি’ মমতার ঠিক করে দেওয়া খাবারও রেখেছেন। বিসিসিআই সভাপতি থাকার সময় কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে নেতাজি জয়ন্তীর কমিটিতে যেমন ছিলেন, তেমনই মমতার ডাকে কলকাতার দুর্গাপুজো নিয়ে অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন এবং বক্তৃতাও করেছেন।
কিন্তু দিনের শেষে তাঁকে সামনে রেখে রান তুলে নিয়ে চলে গেলেন একমেবাদ্বিতীয়ম মমতা! কলকাতার ক্রিকেটমহল এবং রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বললে যা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বস্তুত, সৌরভের ঘনিষ্ঠদের একাংশও তেমনই মনে করছেন।
এক সৌরভ-ঘনিষ্ঠের বক্তব্য, ‘‘দিদি নিশ্চয়ই মহারাজদার ভাল চান। তিনি মোদীকে অনুরোধ করতেই পারেন। কিন্তু সেই অনুরোধ কি প্রকাশ্যে করার প্রয়োজন ছিল? রাজনীতিকদের মধ্যে তো ব্যক্তিগত স্তরেও অনেক কথা চালাচালি হয়। অনেক অনুরোধ-উপরোধের কথা শোনা যায়। উনি সে ভাবে ব্যাপারটা বললে মনে হয় ভাল হত।’’ বস্তুত, তৃণমূল সূত্রের খবর, সৌরভ বিসিসিআইয়ের সভাপতি পদে দ্বিতীয় বার থাকতে পারবেন না, এমন সিদ্ধান্ত হওয়ার পর থেকেই মমতা বিজেপি তথা অমিত শাহকে আক্রমণ করার রাস্তা খুঁজছিলেন। সৌরভের বিভিন্ন হিতৈষী মহল থেকে তাঁকে বুঝিয়েসুঝিয়ে তখনই কিছু না-বলার অনুরোধ করা হয়েছিল। অনেকে মনে করছেন, তখনও সৌরভ নিজে আইসিসির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সে কারণেই মমতাও নীরব ছিলেন। সোমবার আপাতদৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সৌরভকে আইসিসিতে পাঠাতে চান না ভারতীয় ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রকেরা। কালবিলম্ব না করে মুখ খোলেন মমতা।
সোমবার উত্তরবঙ্গ যাওয়ার পথে অনেকটা আচম্বিতেই বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়িয়ে মমতা সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেন, ‘‘আমি সারা পৃথিবীর ক্রিকেটপ্রেমীদের তরফ থেকে বলব, সৌরভ আমাদের গৌরব। সৌরভ যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে মাঠেও খেলেছে, প্রশাসনও চালিয়েছে। ও বিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সৌরভের জন্য ছিল, অমিত শাহের ছেলের জন্যও ছিল। সৌরভ নেই, কিন্তু অমিতবাবুর ছেলে থেকে গেলেন। সৌরভকে বাদ দেওয়া হল কোন উদ্দেশ্যে?’’ পাশাপাশিই মমতা জানান, ওই ‘বঞ্চনা’ পুষিয়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় সৌরভকে আইসিসিতে পাঠানো। তিনি বলেন, ‘‘জগমোহন ডালমিয়া, শরদ পওয়াররা আইসিসিতে গিয়েছিলেন। সৌরভও আইসিসিতে প্রতিনিধি ছিল। আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, দয়া করে সৌরভকে আইসিসির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হোক।’’ একই সঙ্গে মমতা বলেন, ‘‘(কেন্দ্রীয়) সরকারের কাছে অনুরোধ করব, দয়া করে এর মধ্যে রাজনীতি ঢোকাবেন না। কোনও রকম প্রতিহিংসা দেখাবেন না। খেলার স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিন।’’
মমতা যে ‘মাস্ট্রারস্ট্রোক’ দিয়েছেন, তা স্পষ্ট হয়ে যায় সোমবার সন্ধ্যায় বিরোধী দলনেতা তথা রাজ্যে বিজেপির অন্যতম ‘মুখ’ শুভেন্দু অধিকারীর কথায়। গত মে মাসে শাহের সঙ্গে সৌরভের বাড়িতে নৈশভোজে যোগদানকারী শুভেন্দু বলেন, ‘‘আগে শাহরুখ খানকে পশ্চিমবঙ্গের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর পদ থেকে সরিয়ে সৌরভকে ওই পদে বসান। আগে সৌরভকে সম্মান দিন। এ সব নিয়ে রাজনীতি করবেন না।’’ শুভেন্দুর কথায় এটা যেমন স্পষ্ট যে, তাঁরা মনে করছেন মমতা সৌরভকে নিয়ে ‘রাজনীতি’ করছেন, তেমনই এটাও পরিষ্কার যে, বিজেপি সৌরভকে নিয়ে সেই ঈপ্সিত রাজনীতি করতে পারছে না বা পারল না। পাশাপাশি, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘সৌরভকে ছুঁয়ে দয়া করে ওঁর ১২টা বাজাবেন না।’’
অর্থাৎ, বিজেপি এবং সিপিএম— উভয় পক্ষই এখন নিজেদের সৌরভের ‘হিতৈষী’ বলে প্রমাণ করতে চাইছে। কারণ, উভয় তরফই বুঝে গিয়েছে, জয়ের রান তুলে নিয়েছেন দিদি। বেহালার বাঁ-হাতি দাদাকে পিচের উল্টো দিকে নন-স্ট্রাইকার রেখেই। যা দাঁড়াল, সৌরভকে এখন ‘দাদা’ নয়, দিদির ‘ভাই’ হয়েই থাকতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy