মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
গত ১৩ বছরের শাসনকালে ‘প্রশাসক’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রথম বার পিছু হটতে হয়েছিল আরজি কর আন্দোলনের সামনে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তাকে সরিয়ে দিতে এক প্রকার ‘বাধ্য’ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই আন্দোলনের দ্বিতীয়ার্ধ মমতার। আন্দোলন কার্যত থেমে গিয়েছে। যে নাগরিক আন্দোলন রাজ্যের রাজপথে ঢেউ তুলেছিল, তার ছিটেফোঁটাও আর সে ভাবে নেই। উপরন্তু, ছ’টি বিধানসভার উপনির্বাচনে তৃণমূল জিতেছে ‘দাপট’ দেখিয়ে। তার পরবর্তী অধ্যায়ে মমতা দলের অন্দরে এবং সরকারে তাঁর ‘নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ’ রাখার প্রশ্নে যে সমস্ত ‘বার্তা’ দিচ্ছেন, তা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, আরজি কর পর্বে মুখ্যমন্ত্রী যতটা ‘কোণঠাসা’ ছিলেন, এখন ততটাই ‘আক্রমণাত্মক’। এক সোমবার থেকে আর এক সোমবার— আট দিনের মধ্যে তিনটি ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূলনেত্রীর সেই মনোভাব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
এক সোমবার কালীঘাটের বাড়ির লাগোয়া দফতরে দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক করেছিলেন মমতা। সেখানে গৃহীত একগুচ্ছ সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, দল এবং সরকারে ‘নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব’ রাখছেন তিনি। আর এক সোমবার বিধানসভার পরিষদীয় দলের বৈঠকেও মমতা যা বলেছেন, তাতে আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, তাঁর ‘এক এবং একমাত্র’ নেতৃত্ব নিয়ে কোথাও যেন কোনও ‘ধোঁয়াশা’ না থাকে। সংসদে দলের ভূমিকা এবং অবস্থান কী হবে, সে ব্যাপারেও যে তিনিই শেষ কথা বলবেন, দুই সোমবারের মধ্যে তা-ও খোলসা করে দিয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী।
অর্থাৎ, দলে, সংসদীয় দলে এবং পরিষদীয় দলে তিনিই শেষ কথা। সরকারে তো বটেই। কারণ, তিনিই মুখ্যমন্ত্রী। মমতার কথায় স্পষ্ট যে, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে সরকার তো বটেই, তৃণমূলও আগাপাশতলা চলবে তাঁরই পরিকল্পনা মতো। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ্যেই তা জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। কিন্তু তিনি এতটা ‘আক্রমণাত্মক’ হলেন কেন? এই প্রশ্নের পাশাপাশিই শাসক শিবিরের অন্দরে সমান্তরাল ভাবে আলোচনা শুরু হয়েছে দলীয় সংগঠনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা এবং ভবিষ্যৎ নিয়েও। কোনও নেতাই আনুষ্ঠানিক ভাবে অবশ্য কিছু বলছেন না। তবে একান্ত আলোচনায় এটা বলছেন যে, যদি বা কোনও ‘জটিলতা’ তৈরি হয়েও থাকে, তা মিটতেও বেশি সময় লাগবে না। অতীতের বিভিন্ন উদাহরণ তেমনই বলছে।
কেন মমতা দল নিয়ে এতটা ‘আক্রমণাত্মক’ ভূমিকা নিলেন, তার একাধিক কারণ এবং ব্যাখ্যা তৃণমূলের অন্দরে রয়েছে। যেমন রয়েছে প্রশাসনিক মহলেও। মূলত তিনটি কারণের কথা বলা হচ্ছে। তবে উভয় তরফই যে কারণটিতে সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে, তা হল আরজি কর নিয়ে আন্দোলনের পরে উপনির্বাচনে বিপুল জয়। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘উনি খোঁজখবর নিয়ে জেনেছেন, এখনই রাজ্যে বিধানসভা ভোট হলেও বিজেপি ৫০টার বেশি আসন পাবে না! ফলে ওঁর আত্মবিশ্বাস বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে।’’ তবে খানিক ‘রক্ষণশীল’ নেতারা বলছেন, ‘‘প্রতিষ্ঠানের উপরে রাগ এবং ক্ষোভ একেবারে চলে গিয়েছে, উপনির্বাচনের ফলাফল দেখে এটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। যেমন বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরেছে দেখে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে, তাদের উপর দেশের মানুষের তেমন কোনও রাগ বা ক্ষোভ নেই। রাগ আছে। রাস্তায় তার বহিঃপ্রকাশও আছে। কিন্তু ভোটে তার কোনও প্রতিফলন হয়নি, হচ্ছে না।’’
মমতাই ‘মুখ’, ভোট প্রকল্পে
আরজি কর আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে মমতা নিজের মতো করে বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য নিয়েছেন। সেই তথ্যের নির্যাস— এখনও পর্যন্ত তৃণমূল ভোট পাচ্ছে ‘জোড়াফুল’ প্রতীকের জোরে এবং সরকারি পরিষেবামূলক প্রকল্পের জন্য, যার মধ্যে অন্যতম ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ এবং ‘কন্যাশ্রী’। উল্লেখ্য, ‘জোড়াফুল’ প্রতীক এবং সরকারি প্রকল্প— দু’টির সঙ্গেই মমতার ‘মুখ’ সমার্থক। এর ‘বিকল্প’ এখনও নেই বলেই অভিমত তৃণমূলের প্রথম সারির অধিকাংশ নেতার। এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর মতে, মমতা এ-ও বুঝেছেন যে, বাংলায় বিরোধীদের কোনও সংগঠন নেই। ‘নাটকীয়’ কিছু না-ঘটলে ২০২৬ পর্যন্ত পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। তবে ‘সাবধানি’ নেতাদের বক্তব্য, ২০০৬ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছিল, তখন কেউ ভাবেননি যে, কয়েক মাসের মধ্যে সিঙ্গুর এবং তার কয়েক মাসের মধ্যে নন্দীগ্রামের ঘটনা ঘটবে। ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটের পর এটাও অভাবনীয় ছিল যে, তার পাঁচ বছরের মধ্যে সিপিএমকে বাংলার ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হবে। ফলে রাজনীতিতে ‘শেষ কথা’ বলে কিছু বলে দেওয়া যায় না। তবে পাশাপাশিই ওই নেতাদের বক্তব্য, ‘‘মমতা আগামী দেড় বছরে সরকার চালাতে গিয়ে বুদ্ধদেবের মতো কোনও ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্ত নেবেন না। বরং লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের আওতায় আরও মানুষকে আনা বা ওই অর্থের বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ইতিবাচক পদক্ষেপ করবেন।’’
ডায়মন্ড হারবার মডেল
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর অভিষেককে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতা। তার পর থেকে সংগঠনের বিষয় অভিষেকই দেখতেন। তবে সব সময় অভিষেক যে নিজের ভাবনা সংগঠনে বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন, তা নয়। যা নিয়ে মাঝেমাঝে মমতা-অভিষেকের ভাবনার ‘বৈপরীত্য’ এবং সেই সংক্রান্ত মত-পাল্টা মতও প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। কিন্তু সার্বিক ভাবে অভিষেকই যে সংগঠনের দায়িত্বে, তা নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি মমতা যে ভাবে ধারাবাহিক ভাবে দলের উপর নিজের ‘নিরঙ্কুশ’ প্রাধান্যের বার্তা দিচ্ছেন, তাতে সংগঠনে অভিষেকের ভূমিকা এবং তাঁর ‘এক্তিয়ার’ নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে দলের মধ্যে। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, মমতার শাসনকালে সবচেয়ে ‘কঠিন’ সময় গিয়েছে আরজি কর আন্দোলনের পর্বে। প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক— উভয় দিকেই তৃণমূল একটা টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়েছিল। তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, সেই পর্বে অভিষেক ‘সক্রিয়’ না হয়ে কিছু এক্স পোস্টের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। তবে অভিষেকের ঘনিষ্ঠদের একাংশের দাবি, আরজি করের বিষয়ে তাঁকে ‘ঢুকতে দেওয়া হয়নি’। সেই কারণেই অভিষেক খানিকটা ‘দূরত্ব’ বজায় রেখেছিলেন। যদিও প্রকাশ্যে কেউই ওই দাবি করেননি। সেই পর্বেই সমাজমাধ্যমে অভিষেকে ‘মুগ্ধ’ (অনেকে বলেন, তাঁর ‘বাহিনী’) লোকজনের ‘দাদাকে চাই’ গোছের প্রচার মমতা ভাল ভাবে নেননি। এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘বিভিন্ন ঘটনায় দলের একাংশ মমতাদির সম্পর্কেই অনাস্থা প্রদর্শন করছিল। সেটা ঠিক হচ্ছিল না। দিদি সেটা বুঝতে পেরেই যা করার করেছেন।’’
জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকের পর দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেককে ‘দিল্লির মুখপাত্র’ বলে বর্ণনা করেছিলেন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তা নিয়ে দলের অন্দরে টানাপড়েনও শুরু হয়েছিল। অভিষেক-ঘনিষ্ঠেরা পত্রপাঠ বলেছিলেন, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কখনওই দলের ‘মুখপাত্র’ নন। সংসদে দলের ভূমিকা কী হবে এবং জাতীয় স্তরের বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দেবেন তিনি। গত সপ্তাহে তৃণমূলের সংসদীয় দলের বৈঠকে অভিষেক ‘নেতা’র ভূমিকাতেই তাঁর মতামত দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরদিনই মমতা লোকসভা এবং রাজ্যসভার পাঁচ সাংসদের নাম করে বলে দেন, সংসদে দলের অবস্থান কী হবে, তা ওই পাঁচ জন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে জানাবেন। তিনি তাঁদের পরামর্শ দেবেন। মমতা বলেছিলেন, ‘‘কোনও ব্যক্তিবিশেষের সিদ্ধান্তে দলের অবস্থান ঠিক হবে না।’’ পাশাপাশিই বলেছিলেন, ‘‘আমিই সংসদীয় দলের চেয়ারপার্সন।’’ তার পিঠোপিঠিই ডায়মন্ড হারবারের কর্মসূচির মঞ্চ থেকে অভিষেক বলেছিলেন ‘‘আমি ‘আমি’তে নয়, ‘আমরা’য় বিশ্বাস করি। টিমওয়ার্কে বিশ্বাস করি।’’ তার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সোমবার মমতা ফের দলীয় বিধায়কদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনিই ‘চেয়ারপার্সন’। ঘটনাপ্রবাহ দেখে তৃণমূলের এক সাংসদ বলছেন, ‘‘লোকসভা ভোটের ছ’মাস আগে দলে কৌতূহল ছিল, অভিষেক কি ডায়মন্ড হারবারের চৌকাঠ পেরিয়ে সারা রাজ্যে পা রাখবেন? ছ’মাস পর দলে প্রশ্ন, অভিষেককে কি আবার ডায়মন্ড হারবারের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ করে দেওয়া হল?’’ খানিক হালকা চালে তাঁর মন্তব্য, ‘‘এটা দিদির ডায়মন্ড হারবার মডেল নয়।’’
পুরনো চাল, প্রবীণ চলন
অভিষেক দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রাথমিক ভাবে সংগঠনে যে ‘সংস্কার’ করেছিলেন, তা হল প্রশাসনিক জেলায় একাধিক সাংগঠনিক জেলা গঠন করা। তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বেশি সংখ্যক নেতৃত্ব তৈরি করা এবং তাঁদের দলের অন্দরে ‘জায়গা’ দেওয়া। সেই ব্যবস্থা এখনও চালু আছে। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে একাধিক পুরনো এবং অধুনা ‘ব্রাত্য’ নেতার থেকে সংশ্লিষ্ট জেলার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন মমতা। এর শুরু আরজি কর পর্বে। ওই নেতারাই মমতাকে বলেছিলেন, নাগরিক আন্দোলনের কোনও ‘প্রভাব’ ভোটে পড়বে না। শহর এবং মফস্সলের বাইরে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে যে আরজি কর আন্দোলনের ‘প্রভাব’ নেই, মমতাকে তা-ও বলেছিলেন তাঁরা। সেই তথ্য মিলে গিয়েছে। যে নেতাদের থেকে মমতা খবরাখবর নিচ্ছেন বা নিয়েছেন, তাঁরা অবিভক্ত জেলার সভাপতি ছিলেন বলেই তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য। সে খবর রয়েছে অনেক বর্তমান সাংগঠনিক জেলা সভাপতির কাছে। তাঁরা একান্ত আলোচনায় সে কথা গোপনও করছেন না।
প্রবীণ এবং পুরনো নেতাদের থেকে জেলার খোঁজ নেওয়া, জাতীয় কর্মসমিতিতে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, মালা রায়দের মতো প্রবীণদের সংযোজন, মুখপাত্রদের তালিকা থেকে ‘অভিষেক-ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিতদের বাদ রাখার মতো সিদ্ধান্ত দেখে তৃণমূলের বিভিন্ন পর্যায় এই বার্তা পেয়েছে যে, ‘নবীন তত্ত্ব’ খারিজ করে দিয়েছেন দলের সর্বোচ্চ নেত্রী। সামগ্রিক ভাবে মমতার ‘কথা’ এবং ‘বার্তা’ যে ‘আক্রমণাত্মক’ হয়েছে, তা নিয়ে তৃণমূলের কারও সংশয় নেই। তবে অনেকের বক্তব্য, এর সঙ্গে মিশে রয়েছে অভিমানও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy