Advertisement
১১ অক্টোবর ২০২৪
Balurghat Dandi Controversy

দণ্ডি-কাটানো কিস্কু, মুর্মু, সোরেনরা ভোটের গণ্ডিতে বড় মূল্যবান, চিন্তা মমতার, অঙ্ক সুকান্তদের

যে অঙ্কে বিজেপি দ্রৌপদী মুর্মুকে দেশের রাষ্ট্রপতি করেছে, সেই অঙ্ক রয়েছে এই রাজ্যেও। তাই এমন বিষয় ছাড়তে নারাজ গেরুয়া শিবির। যেমন পাল্টা পদক্ষেপে সময় নেয়নি তৃণমূলও।

Why BJP is so aggressive on Balurghat Dandi Controversy

দণ্ডিকাণ্ড নিয়ে রাজনীতির পিছনে অনেক অঙ্ক। — ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৩ ২০:৩০
Share: Save:

শুক্রবার রাতে বালুরঘাটের তৃণমূল পার্টি অফিসে হওয়া দণ্ডিকাণ্ড শোরগোল ফেলেছে গোটা রাজ্যে। ‘নিন্দনীয়’ ওই ঘটনায় শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপান-উতোরও। কিন্তু কেন এত চিন্তা বা উৎসাহ কিস্কু, মুর্মু, সোরেন, মারান্ডি পদবীধারী চার মহিলাকে নিয়ে? এর উত্তর তাঁদের পদবিতেই।

ঘটনাক্রম বলছে, তপন বিধানসভার বিজেপি বিধায়ক বুধরাই টুডুর উপস্থিতিতে গোফানগর অঞ্চলের প্রায় ২০০ জন মহিলা এবং তাঁদের পরিবার তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেন। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন শনকইর গ্রামের বাসিন্দা মার্টিনা কিস্কু, শিউলি মারডি, ঠাকরান সোরেন এবং মালতী মুর্মু। সেই কথা চাউর হতেই চার আদিবাসী মহিলাকে বালুরঘাট নিয়ে যাওয়া হয় এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের তৃণমূল মহিলা মোর্চার জেলা সভাপতি প্রদীপ্তা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তাঁদের ‘ঘর ওয়াপসি’ হয়। তার আগে অবশ্য ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে হয় চার মহিলাকে। বালুরঘাট কোর্ট মোড় থেকে তৃণমূল পার্টি অফিস পর্যন্ত দণ্ডি কাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। সেই ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে।

তার পরেই বিজেপি ‘তৃণমূল আদিবাসী বিরোধী’ স্লোগান তুলে প্রচারে নামে। এমন বিষয় হাতছাড়া করতে চায়নি তারা। রাজ্যের সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে গেরুয়া শিবির। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের লোকসভা এলাকার অন্তর্গত তপন। আবার তাঁর শহর বালুরঘাটেই হয়েছে দণ্ডিকাণ্ড। সময় নষ্ট না করেই সুকান্ত চলে গিয়েছেন সেখানে। চিঠি পাঠিয়েছেন দেশের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতিকে। চিঠি পাঠিয়ে জাতীয় তফসিলি জাতি ও উপজাতি কমিশনকে রাজ্যে আনার উদ্যোগও নিয়েছেন।

তৃণমূলও চুপ থাকেনি। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরেই নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছিল তারা। জেলা সভানেত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে অভিযুক্ত মহিলা তৃণমূল নেত্রীকে। সম্ভবত খানিক ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতেই ‘ব্রাহ্মণ’ প্রদীপ্তা চক্রবর্তীকে সরিয়ে দায়িত্ব দিয়েছে আদিবাসী স্নেহলতা হেমব্রমকে।

বিজেপির বিক্ষোভের ‘পাল্টা’ তৃণমূলের এই সিদ্ধান্তের পিছনের কারণ জানতে কয়েকটা অঙ্কের দিকে নজর দিতে হবে। সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। তার পরে পরেই লোকসভা ভোট। এ যাবত বাংলায় বিজেপির সবচেয়ে ভাল ফল হয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। সেখানে দেখা গিয়েছিল, রাজ্যের সংরক্ষিত আসনগুলি জয়ের ক্ষেত্রে শাসক তৃণমূলের থেকে অনেকটাই এগিয়েছিল বিজেপি। আবার অসংরক্ষিত মালদহ-উত্তর আসন থেকে বিজেপির টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের খগেন মুর্মু। আদিবাসী নেতা কুনার হেমব্রম সাংসদ হয়েছিলেন ঝাড়গ্রাম থেকে। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি আশানুরূপ ফল করতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু বুধারি টুডু, দুর্গা মুর্মু, কমলাকান্ত হাঁসদারা বিধায়ক হয়েছেন।

আর পঞ্চায়েত নির্বাচনের নিরিখে দেখলে বাংলার গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকাতে হবে। এই রাজ্যে তফসিলি উপজাতি অধ্যুষিত ১৬টি বিধানসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল ৯টিতে এবং বিজেপি ৭টিতে জয় পায়। আবার তফসিলি জাতি অধ্যুষিত ৬৮টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৩৬টি এবং বিজেপি ৩২টিতে জয় পায়। এখানে উল্লেখ্য, মোট সংখ্যায় তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও বিজেপি জিতেছিল যে মোট ৭৫টি আসনে, তার মধ্যে ৪১টি তফসিলি জাতি বা উপজাতি আসন। অর্থাৎ বিজেপির জেতা আসনের মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশ ওই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। গেরুয়া শিবির তাই মনে করে আদিবাসী ভোট বিজেপির কাছে বড় সম্পদ।

শুধু এ রাজ্যেই নয়। গোটা দেশের ছবিও বিজেপির কাছে একই। সেই কারণেই রাষ্ট্রপতি পদে বিজেপির বাছাই দ্রৌপদী মুর্মু। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা ২০২৪ সালে ক্ষমতায় ফেরার অঙ্ক কষেই যে দ্রৌপদীকে বেছেছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলার শালতোড়া আসনে চন্দনা বাউড়ি প্রার্থী হলে স্বয়ং মোদী তাঁর হয়ে প্রচারে আসেন। চন্দনাকে ‘গোটা বাংলার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। আবার দ্রৌপদীকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করার পর মোদী টুইটে লিখেছিলেন, দ্রৌপদী প্রান্তিক ও গরিব মানুষের জন্য অনেক কাজ করেছেন। অনেক মিল দ্রৌপদী-চন্দনার। দু’জনেই মহিলা, গরিব এবং পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। সেই মিল রয়েছে তপনের তিন মহিলা মার্টিনা, শিউলি, ঠাকরান এবং মালতীর মধ্যেও। দ্রৌপদী, চন্দনা জিতেছেন। আর তপনের অখ্যাত চার নারী জেতাবেন। এটাই মূল অঙ্ক বিজেপির। তাই দেশের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতিকে চিঠি পাঠিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে সুকান্তরা ফিরিয়ে এনেছেন আদিবাসী অঙ্ক।

২০১৯ সালের ‘লোকনীতি-সিএসডিএস’-এর সমীক্ষা বলছে, ভারতে গড়ে ভোট পড়ে ৬২ শতাংশ। সেখানে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৭২ শতাংশ মানুষ ভোট দেন। সেই সমীক্ষাই বলছে, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ওবিসি ভোট পেয়েছিল ২২ শতাংশ। আঞ্চলিক দলগুলি পেয়েছিল ৪২ শতাংশ। আর ১০ বছর পরে ২০১৯ সালে বিজেপির দখলে আসে ৪৪ শতাংশ ওবিসি ভোট। আঞ্চলিক দলের প্রাপ্তি কমে হয় ২৭ শতাংশ। শুধু ওই সম্প্রদায়ের সমর্থন বিজেপির প্রতি বেশি তাই নয়, ভোটদানের হারের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আদিবাসী মানুষেরা। ভোটের অঙ্কে এমন যাঁদের ‘রেকর্ড’, তাঁরা এমনিতে যতই হেলাফেলার হোন না কেন, রাজনীতির পাশাখেলায় তাঁদের গুরুত্ব কম নয়। এর উপরেও রাজ্য বিজেপির আর একটি অঙ্ক রয়েছে। গত বিধানসভা ভোটের বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছিল, রাজ্যের মহিলা ভোটের বড় অংশ তৃণমূলের পক্ষে গিয়েছিল। বাংলার ‘নিজের মেয়ে’ মমতার প্রতি মহিলাদের সমর্থনকে টেক্কা দেওয়া সহজ কি না, তা নিয়ে সন্দিহান বিজেপি শিবির।

অন্য বিষয়গুলি:

BJP TMC Sukanta Majumdar Mamata Banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE