এক ধাক্কায় পৃথিবী যেন বদলে গিয়েছে ট্যাংরার চিত্ত নিবাসের বছর বারোর কিশোরের! আপাতদৃষ্টিতে আড়ম্বরপূর্ণ জীবনে অভ্যস্ত কিশোরের মাথা গোঁজার ঠাঁই এখন কোথায় হবে? কে দেখভাল করবে?— এই প্রশ্নই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত কিশোর হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই কখনও বলছিল, ‘বাবা কোথায়?’ কখনও আবার জানতে চাইছিল, ‘কাকা কী করছে’? দিনভর টানাপড়েনের মধ্যেই সোমবার সন্ধ্যায় ওই কিশোর এবং তার কাকা প্রসূনকে বাইপাসের ধারের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়।
মঙ্গলবার রাতে অভিষিক্তা মোড়ে দুর্ঘটনায় পর প্রসূন, প্রণয় এবং প্রণয়ের কিশোর পুত্রকে ই এম বাইপাসের ধারের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে ভর্তি আহতদের দেখতে দে পরিবারের আত্মীয়দের কেউ আসেননি। হাসপাতাল থেকে তিন জনকে স্থানান্তরিত করা নিয়েও পুলিশকে সমস্যায় পড়তে হয়েছে বার বার। গোটা দিন টানাপড়েনের পর কোনও মতে এক আত্মীয়কে এনে শনিবার রাতে এন আর এস হাসপাতালে প্রণয়কে ভর্তি করতে পেরেছিল পুলিশ। বেসরকারি হাসপাতালেই ছিল চিকিৎসাধীন কিশোর এবং তার কাকা প্রসূন। পরে তাঁদেরও স্থানান্তরিত করা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। সোমবার দফায় দফায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ। মূলত, কিশোরকে দেখভালের দায়িত্ব পরিবারের কাউকে দেওয়া যায় কি না, সেই চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়া তো দূর, কেউই বেসরকারি হাসপাতালে এসে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় সই পর্যন্ত করতে রাজি ছিলেন না। দীর্ঘ টানাপড়েনের পর শেষে সন্ধ্যায় দুজনকে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বের করা হয়।
এ দিন রাত সাড়ে আটটা নাগাদ দু’জনকে এনআরএস হাসপাতালে অর্থোপেডিক বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। প্রণয়ও ওই ওয়ার্ডেই রয়েছেন। তবে হাসপাতালে রেখে কিশোরের চিকিৎসা হলেও পরে যদি কেউ দায়িত্ব নিতে না চায়, তা হলে তাকে কোথায় পাঠানো হবে, এই প্রশ্নই এখন ঘোরাফেরা করছে। চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (সিডব্লিউসি)-র তরফে শিশুর দেখভালের প্রশ্নে এ দিন ট্যাংরা থানায় তদন্তকারী আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সিডব্লিউসি-র কলকাতা জেলার চেয়ারপার্সন মহুয়া শূর বললেন, “কিশোরের বাবা এবং কাকা জীবিত। যে হেতু কিশোরের অভিভাবকরা আছেন, তাই এখনই আমরা কিশোরকে হোমে পাঠাতে পারি না। তবে নজর রাখছি, যদি কেউ কিশোরের দায়িত্ব নিতে রাজি না হন, তা হলে পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”
ট্যাংরা কাণ্ডের তদন্তে লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনার দু’দিন আগে থেকে রোজ রাতে পায়েস খেয়েছিল দে পরিবার। সেই পায়েসেও তুলসি পাতা মেশানো ছিল। সন্তানদের যাতে কোনও ভাবে সন্দেহ না হয়, সে জন্যেই প্রসূন ও প্রণয় এই পরিকল্পনা করেছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। শেষে সোমবার রাতে ঘুমের ওষুধ মেশানো হলেও সন্দেহ হয়নি বাচ্চাদের। মঙ্গলবার সকালে ঘুম ভাঙার পর মা ও কাকিমাকে নিজের ঘরে শুয়ে থাকতে দেখেছিল কিশোর। দিদি প্রিয়ম্বদারও সাড়া ছিল না। জীবিত তিন জনের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পেরেছিল, প্রথমে প্রিয়ম্বদার ঘরেই কিশোরের হাতের শিরা কাটার চেষ্টা করেন প্রসূন। কিন্তু কিশোর কান্নাকাটি শুরু করায় থেমে যান। এর পর কিশোরকে তিন তলায় ঘরে পাঠিয়ে দুই স্ত্রীর শিরা কাটা হতে পারে বলে পুলিশের অনুমান। পুলিশ বিষয়টি যাচাই করে দেখছে। তবে ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালেই যে হাতের শিরা কেটে খুন করা হয়, তা নিয়ে নিশ্চিত লালবাজার।
লালবাজার জানতে পেরেছে, ঘুমের সমস্যা থাকায় বড় ভাই প্রণয় নিয়মিত ঘুমের ওষুধ কিনতেন। সেই ঘুমের ওষুধই পায়েসে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে অনুমান। ওই এলাকার আশেপাশের ওষুধের দোকানগুলিতে খোঁজ নিচ্ছেন তদন্তকারীরা। দে পরিবারের এই চারতলা বাড়ি থেকে দু'টি ফ্রিজ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। দু’টি ফ্রিজ ভর্তি খাবার ছিল। তা হলে কি ঘরের ভিতরেই বেশ কিছু দিন থাকার পরিকল্পনা ছিল?
তদন্তে লালবাজার জানতে পেরেছে, ব্যবসা বাঁচাতে ছ’টির বেশি সংস্থায় ঋণ ছিল দে পরিবারের। সেই ঋণের পরিমাণ ১৫ কোটির বেশি। ব্যবসার মোড় ঘোরাতে না পারায় সপরিবার মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়। লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “দুই ভাইয়ের বক্তব্যের কিছুটা মিললেও বড় অংশে অসঙ্গতি রয়েছে। পরে দু’জনের সঙ্গে একত্রে কথা বলা হবে। দু’টি ফ্রিজে কেন এত খাবার মজুত করা হয়েছিল, তা দেখা হচ্ছে।”
- ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৩টের পরে অভিষিক্তা মোড়ের কাছে একটি স্তম্ভে ধাক্কা দিয়েছিল তাঁদের গাড়ি। প্রণয় এবং প্রসূন দাবি করেছিলেন, আত্মহত্যা করার জন্যই ওই পদক্ষেপ করেছিলেন তাঁরা। প্রণয়ের বয়ানও খতিয়ে দেখতে চায় পুলিশ।
- সোমবার রাতে প্রসূনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর দাদা প্রণয় দে এবং প্রণয়ের কিশোর পুত্র প্রতীপ এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রতীপ জানিয়েছে, কাকা তাকেও খুন করার চেষ্টা করেছিলেন। মঙ্গলবার প্রসূনকে আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। ৬ মার্চ পর্যন্ত তাঁকে পুলিশি হেফাজতে থাকতে বলা হয়েছে।
-
ট্যাংরাকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে কিশোর প্রতীপের বয়ান! গোপন জবানবন্দি নিতে নির্দেশ কোর্টের
-
কাকে কখন খুন? সব ঠিক বলছেন কি? প্রসূনকে ট্যাংরার বাড়িতে নিয়ে গেল পুলিশ, হল ঘটনার পুনর্নির্মাণ
-
কন্যা প্রিয়ম্বদার পা চেপে ধরেছিলেন মা রোমি, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেন তিনিই! দাবি প্রসূনের
-
আইনজীবী রাখতে চাইছেন না ট্যাংরাকাণ্ডের প্রসূন! বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে পাঠাল আদালত
-
স্ত্রী, মেয়ে ও বৌদিকে খুন! দে বাড়ির ছোট ছেলে ট্যাংরাকাণ্ডে গ্রেফতার, সোমেই ছাড়া পান হাসপাতাল থেকে
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)