আরজি কর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পরেই আন্দোলনে নেমেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। ছবি: রয়টার্স।
আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার পরেই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। প্রথমে সব মিলিয়ে দাবি ছিল ১২ দফা। তা থেকে একটি অবশ্য পরে বাদ যায়। সেই দাবি ছিল নির্যাতিতার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ। বাকি ১১টি দাবি নিয়ে গত তিন মাস দীর্ঘ টানাপড়েন চলেছে। এক দিকে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা। অন্য দিকে সরকার পক্ষ। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের ‘চাপে’ কখনও সরকার পক্ষ পিছু হটে দাবি মেনেছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে ‘কঠোর’ও থেকেছে। কখনও ‘কঠোর’ থেকেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। কখনও ‘নমনীয়’ হতে হয়েছে তাঁদের।
ঘটনায় অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ারকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। কিন্তু তাদের তদন্ত পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আদালতের নির্দেশে তদন্তের ভার গিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে। এখনও পর্যন্ত তারাও একজনকেই ‘দোষী’ বলে আদালতে জমা-দেওয়া চার্জশিটে বর্ণনা করেছে। তবে ‘তথ্যপ্রমাণ লোপাট’ করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মন্ডলকে। তাঁরা এখন জেল হেফাজতে। যদিও আন্দোলকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা এবং নাগরিক সমাজের একটি অংশ মনে করছেন, এক নয়, একাধিক ব্যক্তি ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। সিবিআইয়ের চার্জশিট তাঁদের ‘পছন্দ’ হয়নি। সে কথা তাঁরা প্রকাশ্যে বলছেনও।
তিন মাস পরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির তুল্যমূল্য খতিয়ান নিয়েছে আনন্দবাজার অনলাইন (সঙ্গের গ্রাফিক দেখুন)। সেই হিসেব কষছেন আন্দোলনকারীরাও। জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে আরজি করে চিকিৎসক অনিকেত মাহাতোর কথায়, ‘‘প্রাপ্তি অনেক! বলে শেষ করা যাবে না। সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ নির্যাতিতার বিচারের দাবিকে সামনে রেখে রাজপথে পা মেলালেন। স্লোগান উঠল। যা নজিরবিহীন।’’ তবে নির্যাতিতার জন্য ‘বিচার’ এখনও মেলেনি বলেই মনে করেন অনিকেত। তাঁর ক্ষুব্ধ মন্তব্য, ‘‘বিচারব্যবস্থার উপর ভরসা রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। আর এমন কত ঘটনা ঘটলে প্রশাসন মনে করবে যে, অনেক হয়েছে! এ বার বিচার দরকার! এটা অপ্রাপ্তির চেয়েও অনেক বেশি বেদনার।’’
সত্যিই। আরজি করের ঘটনা কেন্দ্র করে নজিরবিহীন ‘নাগরিক আন্দোলন’ দেখেছে কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গ। কাতারে কাতারে মানুষ ‘ন্যায়বিচার’ চেয়ে রাস্তায় নেমেছেন। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মিছিল করেছেন। ১৪ অগস্ট অভূতপূর্ব ‘মেয়েদের রাত দখল’ হয়েছে সারা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। সেই রাতেই আবার ভাঙচুর হয়েছে আরজি কর হাসপাতালে। তার পর থেকে নাগরিক সমাজের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। প্রায় প্রতিদিনই সাধারণ মানুষ মিছিল করেছেন কলকাতার রাজপথে। মিছিল হয়েছে মফস্সল শহরেও। আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন সমাজের খ্যাতনামীদের একটি অংশ। তাঁদের মধ্যে যেমন থেকেছেন অপর্ণা সেন, তেমনই থাকতে চেয়েছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও। যদিও অপর্ণাকে ‘চটিচাটা’ স্লোগান শুনতে হয়েছে। যেমন ঋতুপর্ণার গাড়ির উপর হামলা হয়েছে বিক্ষোভ থেকেই। মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন টলিউডের একটি বড় অংশ। তাঁদের পরিসরে তাঁরাও স্টুডিয়োপাড়ায় শাসকদলের ‘হুমকি সংস্কৃতি’ নিয়ে সরব হয়েছেন। গ্যালারিতে বিক্ষোভের ‘ভয়ে’ সল্টলেক স্টেডিয়ামে বাতিল হয়েছে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ‘বড় ম্যাচ’। সেই ‘ডার্বি’ বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একযোগে রাস্তায় নেমেছেন তিন প্রধান ক্লাবের সমর্থকেরা। তাঁদের বিক্ষোভ থামাতেও লাঠি চলেছে বাইপাসে। কলকাতার অন্যতম চওড়া রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে থেকেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
গত তিন মাসে এমন ‘নাটকীয়’ ঘটনা কম ঘটেনি আন্দোলন ঘিরে! একের পর এক ‘বেনজির’ ছবি দেখেছে গোটা রাজ্য। গোটা দেশ। রাজপথে মাইলের পর মাইল জুড়ে মানববন্ধন, মশালমিছিল হয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের লম্বা লম্বা ইমেল চালাচালি হয়েছে। ‘বিচার চাই’ দাবি ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে নিজেদের মতো ছোট-বড় মিছিল এবং জমায়েত করেছেন প্রবাসী বাঙালিরা। যা থেকে সামগ্রিক ভাবে শাসকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কারণে ‘পুঞ্জীভূত’ উষ্মা বেরিয়ে এসেছে।
তার মধ্যেই প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আন্দোলনের ‘রাশ’ হাতে নিতে চেয়েছে। ‘ছাত্রসমাজ’ নামের আড়ালে নবান্ন অভিযান হয়েছে। তাতে লাঠি চলেছে। কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়েছে। অভিযানকারীদের ছোড়া ইটের ঘায়ে রক্তও ঝরেছে প্রশাসনের। তবে ‘রাজনৈতিক পরিপক্কতা’র পরিচয় দিয়েছে বাংলার প্রাক্তন শাসক সিপিএম। তারা আন্দোলন ‘দখল’ করতে যায়নি। তবে তারা লাল ঝান্ডা ছাড়া মিশে থেকেছে আন্দোলনকারীদের ভিড়ে। জুনিয়র ডাক্তারেরা অবশ্য প্রথম থেকেই আন্দোলনকে ‘অরাজনৈতিক’ রাখতে চেয়েছেন। পেরেছেনও। অন্তত প্রকাশ্যে।
তবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ‘রাজনৈতিক মনোভাবাপন্ন’ সিনিয়র ডাক্তারদের একাংশ। তাঁরা সংগঠিত করেছেন ‘দ্রোহের কার্নিভাল’। তা নিয়েও আদালতে মামলা হয়েছিল। বস্তুত, আন্দোলন চলাকালীন কলকাতা হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকাও ‘গুরুত্বপূর্ণ’ থেকেছে। ধৃত আন্দোলনকারীরা জামিন পেয়েছেন আদালতের নির্দেশে। ঘটনাচক্রে, সরকার-কৃত দুর্গাপুজোর কার্নিভাল এবং বিক্ষুব্ধ-পরিকল্পিত দ্রোহের কার্নিভাল একই দিনে এবং প্রায় পিঠোপিঠি রাস্তায় পড়ে যাওয়ায় আন্দোলনকারীদের পরিকল্পিত নির্দিষ্ট এলাকায় ১৬৩ ধারা জারি করেছিল পুলিশ। আদালতে তা খারিজ হয়ে যায়।
জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি দিয়ে শুরু হয়েছিল আন্দোলন। তার পরে লালবাজার অভিযান ঘিরে বৌবাজারে পুলিশি ব্যারিকেডের সামনে রাতভর অবস্থান। শেষমেশ পুলিশের ‘পিছু হটা’। কলকাতা পুলিশের তৎকালীন কমিশনারকে ‘প্রতীকী শিরদাঁড়া’ দিয়ে আসা দাবিসনদ-সমেত। তারও পরে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে স্বাস্থ্যভবনের সামনে টানা অবস্থান। সেখানে আচম্বিতে পৌঁছে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে নবান্নে বৈঠক এবং ‘লাইভ স্ট্রিমিং’ না-হওয়ায় সেই বৈঠক শুরুই না-হওয়া। পরে আবার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বৈঠক। সেই একই সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে স্নায়ুর যুদ্ধে সেই বৈঠকও ভেস্তে যাওয়া। পরে সম্প্রচার ছাড়াই মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বৈঠক। সেখানে সরকারের খানিকটা পিছু হটা। অতঃপর স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান তুলে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি আংশিক প্রত্যাহার।
সেখানেই শেষ হতে পারত ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু হয়নি। সাগর দত্ত হাসপাতালে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনার আবার কর্মবিরতি শুরু হয়েছিল। তার পরে কর্মবিরতি তুলে নিলেও ধর্মতলায় ‘আমরণ অনশন’। পুজোর মধ্যেও সেই কর্মসূচি চলেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন একের পর এক অনশনকারী। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ২১ অক্টোবর নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী-সহ প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর অনশন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যদিও কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, নির্যাতিতার বাবা-মায়ের অনুরোধ মেনে তাঁরা অনশন তুলছেন। নবান্নের কথায় নয়। তুলে নেওয়া হয়েছিল এক দিনের কর্মবিরতির ডাকও। তবে জুনিয়র ডাক্তারেরা জানিয়েছিলেন, অনশন উঠলেও আন্দোলন চলবে।
সেই স্লোগানেরই ফলিত রূপ শনিবার আবার দেখবে কলকাতা। দেখবে রাজ্য। অনশন ওঠার পর থেকে দৃশ্যতই ‘স্তিমিত’ হয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন। ‘ঝাঁজ’ কমেছে নাগরিক আন্দোলনেরও। তবে শাসকের বিরুদ্ধে যে ক্রোধ তৈরি হয়েছিল, তা চলে গিয়েছে কি না, সে বিষয়ে কেউই নিশ্চিত নন। বিরোধীদের চেষ্টা ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত এই ‘গণক্রোধ’ জিইয়ে রাখার। শাসকের চেষ্টা ক্রোধের অপনোদন।
হাজার হোক, ‘অরাজনৈতিক’ অবস্থানও তো আসলে ‘রাজনৈতিক’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy