গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভোট-পরবর্তী ‘হিংসা পরিস্থিতি’ দেখতে বৃহস্পতিবার শীচলখুচি গিয়েছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিককে। কিন্তু তার আগে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রধান মুখ্যমন্ত্রীর এক দফা পত্রযুদ্ধ হয়েছে। বুধবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, সরকারি ‘বিধি এবং রীতি’ ভেঙে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে শীতলখুচি-সহ কোচবিহারের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাজ্যপাল। মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের ১৯৯০ সালের ‘ম্যানুয়্যাল অব প্রোটোকল অ্যান্ড সেরিমনিয়ালস’-এর পরিপন্থী।
পত্রপাঠ মুখ্যমন্ত্রীর পত্রের জবাব দিয়ে রাজ্যপাল লিখেছিলেন, ‘আপনার তরফে যে অবস্থান নেওয়া হয়েছে, আমি তাতে রাজি হতে পারছি না। সাংবিধানিক বিধির প্রতি প্রাথমিক অজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে আপনার চিঠিতে’। দু'জনেই নিয়মের কথা বলেছেন তাঁদের চিঠিতে। ঘটনাচক্রে, ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রীকে অনেক চিঠি লিখেছেন ধনখড়। একবার ১৪ পাতার চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। প্রতিটিতেই তিনি সংবিধানের ১৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে তাঁর অধিকারের ব্যাখ্যা দেন।
কী বলছে সংবিধান? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘সংবিধানের ১৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদে রাজ্যপালের নামে রাজ্য প্রশাসন চললেও আসলে তা মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রী পরিষদই চালায়। কিন্তু নিয়ম মেনে যাবতীয় সিদ্ধান্তের চিঠিতে রাজ্যপালের সাক্ষর থাকে। সংবিধানের ১৬৩ অনুচ্ছেদে এটাও বলা আছে যে, মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রী পরিষদ রাজ্যপালকে যে ভাবে পরামর্শ দেবে, রাজ্যপাল সেই অনুসারে কাজ করবেন।’’ তিনি এ-ও মনে করেন যে, রাজ্যপালের সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, তা মোটেও ভুল নয়।
অতীতে রাজ্যপাল একাধিকবার সংবিধানের ১৬৭ অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে বলেছেন, রাজ্য সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম তাঁকে জানানোটাই নিয়ম। এই প্রসঙ্গে বিশ্বনাথ বলেন, “ওই অনুচ্ছেদে যা বলা আছে তাতে, রাজ্যপাল শুধুমাত্র রাজ্যের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হলেও সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে তাঁকে অবগত করাটা মুখ্যমন্ত্রীর সাংবিধানিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, ভারতীয় সংবিধান যা বলছে তাতে, মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রী পরিষদই রাজ্যের প্রকৃত শাসক।” একইসঙ্গে তাঁর সংযোজন, “রাজ্য সরকারের কাজ সম্পর্কে তথ্যাদি রাজ্যপাল জানাতে চাইলে তা মানতে মুখ্যমন্ত্রী বাধ্য ঠিকই। কিন্তু কী ভাবে তিনি প্রশাসন চালাবেন, সে বিষয়ে জবাবদিহি করতে মোটেও বাধ্য নন। মুখ্যমন্ত্রীর সেই দায়বদ্ধতা শুধু বিধানসভার কাছে।”
সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের বক্তব্যে ফারাক থাকার জন্যই যত অস্পষ্টতা বলে মেনে নিচ্ছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অমল মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, “সংবিধানের ১৬৩ এবং ১৬৪ অনুচ্ছেদ যা বলছে, তাতে রাজ্যপাল প্রশাসনিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার পরামর্শ মেনে চলেবেন। তবে সেখানে ‘বাধ্য’ শব্দটা সংবিধানে লেখা নেই। তথাপি আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম ও প্রথা মেনে রাজ্যপাল সবসময় মন্ত্রিসভার সমস্ত পরামর্শ মেনেই কাজ করেন। কিন্তু তিনি কোথাও যেতে চাইলে বাধা দেওয়া যায় না। একজন নাগরিক হিসেবে তাঁকে সংবিধানের ১৯ ধারা সেই অধিকার দিয়েছে। সেই স্বাধীনতা তিনি ব্যবহার করতেই পারেন।”
রাজ্যপালের শীতলখুচি সফর নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে অমল বলেন, “রাজ্যপাল চাইলে যেতেই পারেন। কারণ, এটা কোনও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়। মুখ্যমন্ত্রী চিঠি না পাঠিয়ে উপেক্ষা করতে পারতেন। কারণ, রাজ্য সরকারের অবস্থান সঠিক হলে রাজ্যপাল জেলাশাসকদের সঙ্গে কথা বললে আপত্তি জানানোর কী দরকার। উপেক্ষা না করলে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকবে।”
তবে এই দ্বন্দ্বের জন্য সংবিধানের ‘অস্পষ্টতা’ই যে দায়ী, তা-ও মনে করেন অমল। তাঁর কথায়, “আসলে সংবিধানে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও এমনটাই ছিল। প্রথা মেনে তিনি মন্ত্রিসভার পরামর্শ মেনে চলতেন। কিন্ত বাধ্যবাধকতা ছিল না। ১৯৭৬ সালে ৭২ নম্বর সংশোধনে আইনে ‘বাধ্য’ শব্দটি লেখা হয়েছে। কিন্তু রাজ্যপালের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। সংবিধান এটা স্পষ্ট করে দিলে মুখ্যমন্ত্রী অনেক বিষয়ে বিনা বাধায় আপত্তি জানাতে পারতেন। এখন যে অবস্থা তাতেও উনি আপত্তি জানাতেই পারেন। কিন্তু রাজ্যপাল সেই আপত্তি মানবেন এমন কোনও বাধ্যাবাধকতা নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy