বিজেপি-র সাংগঠনিক শব্দ ভাণ্ডারের অনেকই অচেনা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
উপরের শিরোনামে যে শব্দগুলি লেখা হয়েছে, তার অর্থ ক’জন বাঙালি জানেন? পরীক্ষা নেওয়া হলে পাসের হার খুব বেশি হবে না সম্ভবত। কিন্তু বিজেপি-র ‘বর্ণপরিচয়’ জুড়ে এমন সব শব্দের ছড়াছড়ি! যার প্রণেতা সঙ্ঘ পরিবার। যার সঙ্গে বিদ্যাসাগরীয় ‘বর্ণপরিচয়’-এর যোজন দূরত্ব!
রেখেছ বিজেপি করে বাঙালি করোনি! গেরুয়া শিবির সম্পর্কে এমন সমালোচনা গত বিধানসভা নির্বাচনের সময় তুঙ্গে উঠেছিল। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের মুখে ‘সুনার বাংলা’ নিয়ে সমালোচনা হলেও সেটা কিন্তু অবাঙালির উচ্চারণ সমস্যা। তবে দলের কর্মীদের ‘কার্যকর্তা’ বলা একেবারেই দলীয় সিদ্ধান্ত।
আসলে বিজেপি গোটা দেশে এক পরিভাষায় কথা বলতে চায়। নিয়মিত বিজেপি দফতর এবং নেতাদের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ রয়েছে, তাঁরা জানেন কোন শব্দের কী অর্থ ধরে নিয়ে লিখতে বা বলতে হবে।
বিজেপি-তে এই সব শব্দের ব্যবহার এসেছে আদর্শগত ভাবে দলের ‘প্রেরণাদায়ক’ সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-এর থেকে। আর যবে থেকে সঙ্ঘ থেকে সরাসরি বিজেপি-তে আসা ব্যক্তিরা দলের শীর্ষস্থানে আসতে শুরু করেন, তখন থেকে সেই প্রবণতা আরও বেড়েছে। এই আলোচনায় দু’টি নামের উল্লেখই যথেষ্ট—নরেন্দ্র মোদী এবং দিলীপ ঘোষ। দু’জনেই আরএসএস প্রচারক ছিলেন। পরে এসেছেন বিজেপি-তে।
ধরা যাক যদি দিলীপ বলেন, ‘‘আগামী সপ্তাহ থেকে আমার উত্তরবঙ্গ প্রবাস শুরু হবে। আজ নিবাসেই রাত্রিবাস। কাল সকালে স্বল্পাহারের পরে পত্রকারদের সঙ্গে কথা বলব। তার পরে বিস্তারক যোজনা নিয়ে একটি বৈঠক রয়েছে। রাষ্ট্রীয় অধ্যক্ষ নড্ডা’জির নির্দেশে এই বৈঠক হবে। এটি অখিল ভারতীয় কার্যক্রম। অনেক আগেই এমন সূচনা এসেছিল। এই প্রদেশের ১০০ যুবক স্বল্পকালীন বিস্তারক হিসেবে নিজেদের পূর্ণকালীন হিসেবে সময় সমর্পণ করবেন। তাঁদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ বর্গও হবে। সম্মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এই ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’’
এই বক্তব্যের অর্থ অনেকের কাছে দুর্বোধ্য নয়। কিন্তু কয়েকটি শব্দ আলাদা ভাবে নজরে আসে। প্রবাস (সফর), নিবাস (সংগঠনের ঠিক করে দেওয়া বাসভবন), স্বল্পাহার (প্রাতরাশ), বিস্তারক (নিজের এলাকার বাইরে গিয়ে যাঁরা দলের কাজ করেন), যোজনা (পরিকল্পনা), বৈঠক (দলের অভ্যন্তরীণ সভা), রাষ্ট্রীয় (জাতীয় বা সর্বভারতীয়) অধ্যক্ষ (সভাপতি), অখিল ভারতীয় (কেন্দ্রীয়), কার্যক্রম (কর্মসূচি), সূচনা (সাংগঠনিক খবর), প্রদেশ (রাজ্য), স্বল্পকালীন (অল্প দিনের জন্য), পূর্ণকালীন (ইংরেজিতে হোলটাইমার), বর্গ (শিবির), আগ্রহ প্রকাশ (চেয়েছেন)। এই শব্দগুলির অনেকগুলি চাইলে বাংলায় ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বিজেপি-র ক্ষেত্রে কার্যত আবশ্যিক।
১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠার পরে সঙ্ঘে মরাঠি শব্দের ব্যবহারই প্রাধান্য পেত। প্রথম সর-সঙ্ঘচালক (প্রধান) কেশব বলিরামরাও হেডগেওয়ার (ডাক্তারজি) ছিলেন মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা। নাগপুরে সূচনা হয় সঙ্ঘের। ধীরে ধীরে অন্য রাজ্যে সংগঠন ছড়াতে শুরু করলে হিন্দির ব্যবহারও বাড়তে শুরু করে। সঙ্ঘের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, প্রথম থেকেই সংগঠনকে সর্বভারতীয় করার পরিকল্পনা ছিল বলে নামে ‘রাষ্ট্রীয়’ শব্দটিকে গোড়ায় রাখা হয়।
তবে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নানা ‘ভাষা’ ব্যবহার নিয়ে নানা মত তৈরি হয় সঙ্ঘে। এর পরে ১৯৩৯ সালে একটি বৈঠকে গোটা দেশে সাংগঠনিক ভাষা একই করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই বৈঠকে ‘ডাক্তারজি’ ছাড়াও সঙ্ঘের দ্বিতীয় প্রধান মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর (গুরুজি) এবং আপ্পাজি জোশী মুখ্য ভূমিকা নেন। সেখানেই ঠিক হয়, সংস্কৃতকে প্রাধান্য দিয়ে সঙ্ঘের কুচকাওয়াজে আজ্ঞা (নির্দেশ বা কম্যান্ড) দেওয়া হবে। সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবিরকে আগে বলা হত ‘ওটিসি’। কারণ, আগে ইংরেজির ব্যবহার ছিল বেশি। পরে ‘ওটিসি’ (অফিশিয়াল ট্রেনিং ক্যাম্প) বদলে হয় ‘সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ’। ‘সর্বজনীন’-কে যেমন বলতে হবে ‘সামূহিক’। ‘দৃষ্টিনন্দন মূর্তি’-কে বলতে হবে ‘ভব্য মূর্তি’।
সঙ্ঘের বিভিন্ন সাংগঠনিক পদের নামও সংস্কৃতে ঠিক করা হয়। মরাঠি ও হিন্দি ভাষায় সঙ্ঘের প্রার্থনা বদলে হয় সংস্কৃতে। ১৯৪০ সালের ১৮ মে প্রথমবার সেই প্রার্থনা নাগপুরে গেয়েছিলেন সঙ্ঘ প্রচারক যাদবরাও জোশী। এর পরে আর প্রার্থনার বদল হয়নি। সঙ্ঘের ‘আজ্ঞা’-র প্রভাব কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিজেপি-তে দেখা যায়। গোল হয়ে কর্মীদের বসিয়ে সংগঠনের ছোট সভাকে ‘মণ্ডল বৈঠক’ বলার রেওয়াজ এসেছে সঙ্ঘের নির্দেশ-পদ্ধতি থেকেই।
তবে সঙ্ঘ থেকেই প্রভাবিত বিজেপি-র সাংগঠনিক ভাষা। সেই কারণেই বিজেপি-র রাষ্ট্রীয় পরিষদ (ন্যাশনাল কাউন্সিল), প্রদেশ কার্যকারিণী (স্টেট এগ্জিকিউটিভ) মণ্ডলীর বৈঠক বসে। ‘প্রভারী’ মানে পর্যবেক্ষক। পশ্চিমবঙ্গের প্রভারী কৈলাস বিজয়বর্গীয়। সম্প্রতি উত্তরাখণ্ডের ‘সহ-প্রভারী’ হয়েছেন লকেট চট্টোপাধ্যায়। অফিস সেক্রেটারির সাংগঠনিক নাম ‘কার্যালয় প্রমুখ’। কার্যালয়ের যেখানে দলের পতাকা, পোস্টার ইত্যাদি পাওয়া যায়, তার নাম ‘বস্তুভান্ডার’। আর ‘বস্তুভান্ডার প্রমুখ’ (প্রধান)-কেই ‘প্রচার সামগ্রী’ (পোস্টার, বই, ব্যানার, পতাকা ইত্যাদি)-র হিসেব রাখতে হয়। দলের উপদেষ্টারা হলেন ‘মার্গদর্শক মণ্ডলী’-র সদস্য। যেমন লালকৃষ্ণ আডবাণী। তিনি আবার বিজেপি-র ভাষায় ‘প্রবীণ’ নন। ‘বরিষ্ঠ’।
বিজেপি-র সব শাখা সংগঠনই ‘মোর্চা’। আর সব মোর্চার প্রতিনিধিকে নিয়ে যখন আলোচনা হবে, তখন সেটা ‘সমন্বয় বৈঠক’। সেখানে কোনও ‘কর্মসূচি’ ঠিক হয় না। ‘কার্যক্রম’ চূড়ান্ত হয়। কী কী কাজ হবে তার ‘সূচি’ তৈরি হয় এবং কর্মীদের থেকে অর্থের (টাকা)-র বদলে ‘নিধি’ সংগ্রহ করা হয়।
বিজেপি নেতা-কর্মীদের মুখে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও দলের ব্যবহার করা অনেক শব্দেই কিন্তু বাঙালির কান এখনও অভ্যস্ত হতে পারেনি। যেমন সঙ্ঘ পরিবারের ‘রক্ষাবন্ধন’-কে যে বাঙালি ‘রাখিবন্ধন’ নামেই চেনে ও ভালবাসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy