বাবরের তালাবন্ধ ভাড়া বাড়ি। ছবি: স্বরূপ সরকার।
হেমন্তের বিকেলে পশ্চিম আকাশে তেজহীন সূর্য ডুবছে তখন। অতি সরু গলিটির মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে কানে আসছে ক্ষীণ টিভির আওয়াজ। কোনও জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরের বাতি। যে বাড়িটির খোঁজে ইসলামপুর শহরে, মেলা-মাঠ এলাকার এমন তস্য, নির্জন গলিটিতে আসা, সেটিও খুঁজে পাওয়া গেল শেষে।
বিরাট লোহার দরজা, ভিতর থেকে তালা বন্ধ। নতুন রং করা পাকা বাড়ি, সামনে বারান্দা। উঁকি দিয়ে দেখা গেল, সিঁড়িঘরের তলায় গ্যারাজ। সামনে বাগান। ঘরের সামনে ঘেরা জায়গায় একাধিক ট্রাউজার্স মেলা। সিসিটিভি তাক করা লোহার গেটে। গোটা এলাকায় কেমন যেন বেমানান।
এ বাড়িতে ভাড়া থাকতেন বাবুল হোসেন ওরফে বাবর।
ট্যাব জালিয়াতির বেশ কিছু সুতো এসে মিলেছে বাবরের কাছে। সেই রহস্য খুঁজে দেখতেই উত্তর দিনাজপুরের এই শহরে এমন নির্জন অতি সরু গলিতে ঢুকে পড়েছিলাম। তবে বাড়ি খুঁজে পেলেও দেখা মিলল না বাসিন্দাদের। দরজা ধরে জোর নাড়া দিতেই ঝনঝন আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল গলিতে। অথচ কোনও সাড়া মিলল না ভিতর থেকে। তার পরেই গলির গোড়ায়, যেখানে টিনের সারিবদ্ধ একতলা বাড়িগুলি রয়েছে, তার পিছনে একটি দোতলা বাড়ির বারান্দায় দেখা গেল কালো বোরখা পরা এক মহিলাকে। কানে ফোন। চোখ আমার দিকে। মনে হল, কাউকে কিছু যেন বলছেন। গলির মুখে ঘুগনির একটি ঠেলা এমন ভাবে লাগানো, সেটি পাশ কাটিয়ে সহজে ঢোকা-বেরনো মুশকিল। একটু আগেও সেখানে কেউ ছিল না। এখন দেখি, সেটির পাশে দাঁড়িয়ে দুই তরুণী, সুকৌশলে মোবাইলে ছবি তুলছেন আমার।
বাবরের বাড়ি খুঁজতে একটু আগেই এক তরুণীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সাত দিন ধরে বাড়িতে কেউ নেই। হুট করে সবাই চলে গিয়েছে। আগে লোকজন আসত। বাড়ির মালিক ভোপালে থাকেন।’’ তার পরেই কি গলি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আমার আগমন-বার্তা?
সন্ধ্যা পুরোপুরি নামার আগে অবশ্য বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম গলি থেকে। গলির বাইরে, একটু দূরে পুরো ফাঁকা ইসলামপুরের তৃণমূল বিধায়ক আবদুল করিম চৌধুরীর গোলঘর। লোকজনও জমছে রাস্তায়। এর মধ্যে মোবাইল ক্যামেরা তাক করা দুই তরুণীও যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন। অস্বস্তি এবং প্রশ্ন, দু’টোই রয়ে গেল: তা হলে কি বাবরের বাড়ির এই গলি এই ভাবে অদৃশ্য কোনও সিসিটিভি ক্যামেরায় পাহারা দেওয়া হয়? কেন অপরিচিতদের উপরে এমন নজরদারি? বাবরই কি তবে ট্যাব জালিয়াতির আদত চাঁই?
বাবুল হোসেন ওরফে বাবরের ইসলামপুরের এই তালাবন্ধ বাড়ি ঘিরেই শুধু রহস্য ঘনায়নি। ততোধিক রহস্য রয়েছে উত্তর দিনাজপুরেরই চোপড়া ব্লকের বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া লালবাজার এলাকার বিভিন্ন গ্রামে।
এ এক অন্য লালবাজার। তবে দাসপাড়া পুলিশফাঁড়ির এই লালবাজার পুলিশ-ক্যাম্পেও এখন রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে আসা পুলিশ বাহিনীর ভিড়। বিধাননগরের সাইবার অপরাধদমন শাখা, আলিপুরের ভবানী ভবনের সিআইডির গোয়েন্দা, কলকাতার লালবাজারের গোয়েন্দা-পুলিশকর্মী— কে নেই সেখানে! রোজই আসছেন নতুন অফিসার। তদন্তকারীদের নিয়ে একের পরে এক গাড়ি ধুলো উড়িয়ে ছুটছে সীমান্তের গ্রামে। চলতি সপ্তাহের গোড়া পর্যন্ত ট্যাব-কাণ্ডে উত্তরবঙ্গ থেকে গ্রেফতার জনা ত্রিশ। তাদের অন্তত ৭০ শতাংশ চোপড়া, ইসলামপুরের বাসিন্দা। জালিয়াতির তদন্তের প্রায় সব সূত্র ঘুরেফিরে চোপড়ায় পৌঁছচ্ছে। চোপড়ার লালবাজারকে ঘিরে মূলত ঘিরনিগাঁও, লক্ষ্মীপুর এবং দাসপাড়া এলাকায় চলছে পুলিশি তদন্ত। প্রাথমিক ভাবে তদন্তকারীদের অনুমান, বেআইনি অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে চোপড়ার বিস্তীর্ণ গ্রামীণ এলাকা। উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে কিছুটা দূরে থাকা মূলত, কৃষিজীবী দুঃস্থ শতাধিক পরিবারের বিভিন্ন নথির তথ্য হাতানোই দুষ্কৃতীদের টাকা রোজগারের ‘ট্রাম্পকার্ড’। পুলিশের দাবি, এ জালিয়াতি-চক্রের অন্যতম কারিগর বাবুল হোসেন বা বাবর, সাদিক হোসেন, দিবাকর দাস, মনসুর আলমেরা। তারাই এই কাজে লাগিয়েছিল ২৫-৩০ বছর বয়সী শতাধিক যুবককে।
কী ভাবে? সেই প্রশ্নের জবাব কিছুটা লুকিয়ে আছে সিএসপিগুলিতে।
সীমান্ত লাগোয়া কোটগছ, ডাঙাপাড়া, মণ্ডলবস্তি, গোয়ালগছ, দুলুয়াহাট, মুন্সিগছের মতো প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে চোখে পড়ে বোর্ড-পোস্টার-ফ্লেক্সে সাজানো বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ‘কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্ট’ বা সিএসপি। গ্রামীণ পরিষেবাকেন্দ্র। গড়ে দশটা গ্রামীণ মাটি, টিনের বাড়ির মধ্যে একটিতে রয়েছে ‘সিএসপি’। গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত, টিপ-সই দেওয়া মানুষ থেকে দুঃস্থদের ব্যাঙ্কের লেনদেনের কাজ-সহ যাবতীয় সরকারি ‘অনলাইন’ কাজের সুবিধা মেলে এ সব ছোট্ট অফিসঘরে। স্থানীয় ভাষায়, ‘লোকাল ব্যাঙ্ক’। তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, এই ‘সিএসপি’-র মাধ্যমে জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, রাজ্য সরকারের ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে ট্যাবের জন্য বরাদ্দ হওয়া লক্ষ-লক্ষ টাকা।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy