Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
West Bengal Lockdown

দীর্ঘ নিভৃতবাস শেষে জুটল থালাভরা ভাত 

তিন দিন আগে, সঙ্গে থাকা চিঁড়ে ফুরিয়ে যাওয়ার পরে গত পাঁচ বেলা খিদের সঙ্গে লড়াই করেই কেটেছে তাঁদের।

স্কুলঘরে ভাত জুটেছে পিতা-পুত্রের। বুধবার। নিজস্ব চিত্র

স্কুলঘরে ভাত জুটেছে পিতা-পুত্রের। বুধবার। নিজস্ব চিত্র

বিমান হাজরা
সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২০ ০৩:০৩
Share: Save:

গরম ভাতের কোল ঘেঁষে এক মুঠো লাল শাক, আলু-পটলের তরকারির ঝোল গড়িয়ে চলেছে সাদা ভাতের দিকে। পাশে এক বাটি টলটলে ডাল। কানা-উঁচু ভাতের থালাটা কোলের কাছে টেনে নিয়েই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ছেলেটি। বাপ-বেটাকে ঘিরে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে থাকা ভিড় থেকে এক জন বললেন, ‘‘খা বাবা খা, অন্ন সামনে রেখে কাঁদতে নেই!’’ ভাতের চুড়োয় আঙুল গেঁথে ছেলেটি তবু ফুঁপিয়ে চলে।

দীর্ঘদিন পরে মঙ্গলবার ভাত খেয়েছে আকাশ। আকাশ রায়। পাশেই তার বাবা, বুবাই। তিন দিন আগে, সঙ্গে থাকা চিঁড়ে ফুরিয়ে যাওয়ার পরে গত পাঁচ বেলা খিদের সঙ্গে লড়াই করেই কেটেছে তাঁদের। স্কুলের বারান্দায় দিনের পর দিন লুকিয়ে থাকা সোনারপুরের রাজগ্রামের পিতা-পুত্র শেষতক নেমে আসেন পথে। কথাটা পাঁচ কান হওয়ার পরে আটকে পড়া এই দুই পরিযায়ী শ্রমিককে ভাত জুগিয়েছে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির ছমুগ্রাম। তাঁদের ঘরে ফেরানোর তোড়জোড়ও শুরু হয়েছে। সাগরদিঘির বিডিও শুভজিৎ কুণ্ডু বলেন, ‘‘খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ঘটনাটি সত্যি। ওঁরা ভয় পেয়ে লুকিয়ে ছিলেন। আমরা সরকারি ত্রাণ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গ্রামবাসীরাই ওঁদের দায়িত্ব নিয়েছেন।’’

গঙ্গার উপরে, ফরাক্কায় শুরু হয়েছে নতুন সেতুর কাজ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজগ্রাম থেকে সেখানেই রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে এসেছিলেন বুবাই রায়। সঙ্গে ছিল বছর পনেরোর আকাশ।

আরও পড়ুন: রিকশা চালিয়েই বারাণসী থেকে বাংলায়

বুবাই জানান, ২৫ মার্চ দেশ জুড়ে লকডাউন শুরু হতেই কাজ গুটিয়ে ঠিকাদার জানিয়ে দেয়, ঠাঁই-ভাত জুটবে না কিছুই। তাই ২৭ এপ্রিল ছেলের হাত ধরে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করেন মধ্য চল্লিশের বুবাই। তাঁর কথায়, ‘‘রাস্তা তো চিনি না। তাই ঠিক করেছিলাম, রেললাইন ধরেই হাঁটব।’’ দিনভর লাইন ধরে হেঁটে আহিরণ হল্ট-স্টেশনের কাছে একটি নলকূপ থেকে জল নেওয়ার সময়ে তাঁদের ঘিরে ধরেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা। বুবাই বলেন, ‘‘কোনও কারণ ছাড়াই আমাদের বেধড়ক মারধর করল।’’সেখান থেকে পরিত্রাণ মিললেও কিছু দূর আসার পরে পথ আটকায় রেল পুলিশ। তবে এ বার আর মারধর নয়, বরং কেজি সাতেক শুকনো চিঁড়ে দিয়ে তাঁদের এগিয়ে যেতে বলে। সেই রাতটা একটা ইটভাটায় কাটিয়ে পর দিন ফের শুরু হয় হাঁটা। আকাশ বলে, ‘‘সন্ধের মুখে আর পা চলছিল না।’’ ছমুগ্রামের কাছে ফাঁকা মাঠে ওই স্কুলবাড়িটি দেখে রাতটা সেখানেই কাটিয়ে দেবেন স্থির করেন। কিন্তু, স্কুলে তালা। কার্নিশ বেয়ে ওঠেন দোতলার বারান্দায়।

আরও পড়ুন: মুম্বই ফেরত রোগীদের রাখা হল হাসপাতালে

পরের দিন সকালে সেখান থেকে বাপ-বেটায় দেখেন, গরু চুরি হওয়ায় হাতে খেটো বাঁশ নিয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামের মানুষ। বুবাই বলেন, ‘‘গ্রামের লোকজনের মারমুখী চেহারা দেখে সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম, যদি পিটিয়ে মেরে ফেলে!’’ তার পর থেকে এক চিলতে বারান্দাই হয়ে ওঠে তাঁদের লকডাউনের ঠিকানা। স্কুলের কলের জল আর সঙ্গে থাকা চিঁড়েই ছিল সম্বল। আকাশ বলে, ‘‘বারান্দা থেকেই দেখতাম, চাল-আলু বিলি হচ্ছে। কিন্তু নামার সাহস পাইনি।’’

সঙ্গের চিঁড়ে শেষ হয়ে যাওয়ার পরে জল খেয়েই আড়াই দিন কাটিয়ে দেন দু’জনে। বুবাই বলেন, ‘‘খিদেয় জ্বালায় ছেলেটা কাঁদতে শুরু করল। কেমন নেতিয়ে পড়ছিল। বুঝলাম, এ ভাবে বসে থাকলে চোখের সামনেই ওকে মরতে দেখব।’’ মঙ্গলবার দুপুরে তাই পাশের মাঠে ছেলেদের খেলতে দেখে নেমে আসেন বুবাই। সব কথা খুলে বলেন। ছমুগ্রাম ফিরিয়ে দেয়নি তাঁদের। ওই স্কুলেই থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভূদেব চৌধুরী বলছেন, “এ সময়ে ওঁদের পাশে না-দাঁড়ালে চলে!’’ আর জঙ্গিপুরের এসডিপিও প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ওঁদের ঘরে ফেরানোই আমাদের প্রথম কাজ।’’

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy