—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
চলতি বছরে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের ট্যাব দিতে আনুমানিক ১৫০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে শিক্ষা দফতরের। যেখানে পরিকাঠামোর অভাবে রাজ্যের বহু সরকারি স্কুল কার্যত ‘মৃতপ্রায়’, সেখানে ১৫০০ কোটি টাকা শুধু ট্যাবের পিছনে খরচ করা কতটা যুক্তিযুক্ত, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে শিক্ষা মহলে। বহু শিক্ষকের প্রশ্ন, যেখানে বহু ক্ষেত্রেই স্কুলগুলির ভাঁড়ে মা ভবানি দশা, স্কুল ভবন মেরামতির জন্য পর্যন্ত টাকা পাওয়া যায় না, সেখানে এই বিপুল পরিমাণ টাকা ট্যাবের জন্য বরাদ্দহবে কেন?
শিক্ষকদের একটি বড় অংশের মতে, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ট্যাব জরুরি। কিন্তু ঠিকঠাক ক্লাস-ঘর, আধুনিক ল্যাবরেটরি, মিড ডে মিল-এ পাতে পুষ্টিকর খাবারও তো ভীষণ ভাবে জরুরি। সে কথা কেন ভাবা হচ্ছে না? ১৫০০ কোটি টাকায় কম্পিউটার ল্যাবরেটরি, ডিজিটাল ল্যাবরেটরি, প্রতিটি স্কুলে স্মার্ট ক্লাসরুম তৈরির ক্ষেত্রে উদ্যোগী হওয়া যেত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা দফতরের এক কর্তাই বলছেন, ‘‘নানা কাজে জেলার স্কুলগুলিতে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে দেখেছি অনেক স্কুলেই প্রয়োজনের তুলনায় ক্লাসরুম কম, জানলা-দরজা ভাঙা, ছাদ থেকে চাঙড় খসে পড়ছে। নতুন ভবন প্রয়োজন, কিন্তু বরাদ্দ নেই। মিড ডে মিলের জন্য প্রয়োজনীয় রান্নাঘর নেই। আমার মনে হয় স্কুলের উন্নয়নের জন্য এগুলিই বেশি প্রয়োজনীয়।’’
দ্বাদশের পড়ুয়াদের ট্যাব দেওয়া শুরু কোভিডের সময় থেকে। তবে অন্যান্য বার ১৫০০ কোটি টাকা খরচ হয় না। এ বারই খরচের পরিমাণ এতটা বেশি। এ বছরই শিক্ষা দফতর ঘোষণা করেছে, এ বার থেকে একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়েই ট্যাবের জন্য ১০ হাজার টাকা পড়ুয়াদের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হবে। আগামী বার, অর্থাৎ যাঁরা ২০২৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবেন, তাঁরা এখনও ট্যাবের জন্য ১০,০০০ টাকা পাননি। তাই এ বছর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা একসঙ্গে ট্যাবের টাকা পাবেন।
এই টাকায় যা হয়—
• ৭৫ হাজার স্মার্ট ক্লাসরুম (আনুমানিক গড় খরচ- ২ লক্ষ টাকা)
• ১৫ হাজার নতুন ক্লাসরুম (আনুমানিক গড় খরচ- ১০ লক্ষ টাকা)
• ৭৫ হাজার সিসি ক্যামেরা (আনুমানিক গড় খরচ- ২ লক্ষ টাকা)
• রাজ্যে মিড ডে মিলে উপকৃত ১ কোটি ১৮ লক্ষ পড়ুয়া। প্রাথমিক এবং উচ্চ প্রাথমিকে ২ টাকা করে মোট ৪ টাকা বাড়ালেও বাড়তি খরচ মোটে ৪ কোটি ৭২ লক্ষ টাকা।
*সূত্র- বাংলা শিক্ষা পোর্টাল এবং বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মত
এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে ৭ লক্ষ ৬৫ হাজার ২৫২ জন। শিক্ষা দফতরের হিসাব অনুযায়ী, কিছু পড়ুয়া মাধ্যমিকের পরে পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও, অন্য বোর্ড থেকে কিছু পড়ুয়া উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের অধীনে ভর্তি হচ্ছে। গড়ে সাড়ে সাত লক্ষ পড়ুয়া একাদশে পড়ছেন। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ সূত্রে জানা গিয়েছে, দ্বাদশেও সাড়ে সাত লক্ষের মতো পড়ুয়া এখন পড়াশোনা করছেন। অর্থাৎ একাদশ ও দ্বাদশ মিলিয়ে মোট ১৫ লক্ষ পড়ুয়া। এই ১৫ লক্ষ পড়ুয়ার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা দিতে খরচ হচ্ছে ১৫০০ কোটি টাকা।
শিক্ষা অনুরাগী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী বলেন, “ট্যাবের থেকে স্কুলে কম্পিউটার ল্যাবরেটরি অনেক বেশি জরুরি।” বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনন্দ হণ্ডা বলেন, “মিড-ডে মিল বাবদ কেন্দ্র টাকা বাড়াচ্ছে না বলে বার বার অভিযোগ তোলে রাজ্য। রাজ্য উদ্যোগী হয়ে তো নিজেদের তরফে বরাদ্দ বাড়াতে পারত। এই অগ্নিমূল্যের বাজারে এখনও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মিড-ডে মিল বাবদ বরাদ্দ দৈনিক ৫ টাকা ৪৫ পয়সা। এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত বরাদ্দ ৮ টাকা ১৭ পয়সা। এই ১৫০০ কোটি টাকায় রাজ্যের তরফে বরাদ্দ কি বাড়ানো যেত না?” আনন্দের প্রশ্ন, “আবাস যোজনা তো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প। আবাস যোজনার টাকা কেন্দ্র না দিলে রাজ্য দেবে বলছে। তা হলে মিড-ডে মিলের বরাদ্দ কেন্দ্র না বাড়ালে রাজ্য কেন বাড়াচ্ছে না?”
শিক্ষা দফতরের এক কর্তার অবশ্য যুক্তি, “ডিজিটাল যুগে পড়ুয়াদের হাতে মোবাইল বা ট্যাব থাকা খুব জরুরি। অনলাইন ক্লাস করতে মোবাইল প্রয়োজন। নানা ছুটিছাটায় এখন অনলাইন ক্লাস করছেন শিক্ষকেরা। এই ট্যাব উচ্চ মাধ্যমিকের পরে উচ্চ শিক্ষাতেও কাজে আসবে।” এ দিকে এক শিক্ষকের কথায়, “স্কুলে মোবাইল আনা বারণ। অথচ রাজ্য সরকার একাদশ শ্রেণিতেই পড়ুয়াদের হাতে মোবাইল (ট্যাব) দিয়ে দিচ্ছে। পড়ুয়ারা এ বার স্কুলে মোবাইল আনলে বারণ করতে পারব কি? ওরা তো বলবে শিক্ষা দফতরই দিয়েছে। স্কুলে কেন ফোন আনব না?”
উচ্চ মাধ্যমিকের পড়ুয়াদের ট্যাবের টাকা দেওয়ার থেকে স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়ন বেশি দরকার বলে মনে করে প্রতীচী ইন্ডিয়া ট্রাস্টও। প্রথম এডুকেশন ফাউন্ডেশনের একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, পড়াশোনার থেকে বিনোদনের জন্যই বেশি মোবাইল ব্যবহার করে পড়ুয়ারা। প্রতীচী ইন্ডিয়া ট্রাস্টের গবেষক সাবির আহমেদ বলেন, “উচ্চ মাধ্যমিকের পড়ুয়াদের ট্যাব কেনার টাকা দিয়ে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আরও কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক জন ১৬-১৭ বছরের পড়ুয়ার পক্ষে মোবাইলে অনেক সময়েই নিয়ন্ত্রণ থাকে না। মোবাইলে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ছে পড়ুয়ারা যে, টানা দশ মিনিটও পড়ায় মনোযোগী হতে পারছে না।”
প্রথম এডুকেশন ফাউন্ডেশনের এক আধিকারিক জানান, তাঁদের তরফে ২০২৩ সালে রাজ্য জুড়ে একটি সমীক্ষা হয়েছিল। দেখা যায়, রাজ্যের প্রায় ৯০% পড়ুয়ার কাছে মোবাইল আছে। কিন্তু তারা পড়াশোনার থেকে অনেক বেশি বিনোদনের জন্য মোবাইল ব্যবহার করে। মোবাইল সুরক্ষা সম্পর্কেও অনেকেই বিশেষ কিছু জানে না। যেটা তাদের পক্ষে আরও ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy