গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
একদিকে সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) পদে বদল ঘটিয়ে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে বার্তা। অন্যদিকে, দিলীপ-বিরোধী কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে আপাতত কলকাতা ছেড়ে মধ্যপ্রদেশে বেশি সময় দিতে নির্দেশ। বিধানসভা ভোটের আগে দলের অন্দরে নিত্য দ্বন্দ্বে বিরক্ত বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ বার সরাসরি হস্তক্ষেপ করলেন পশ্চিমবঙ্গে। পাশাপাশিই, দলের প্রথমসারির নেতা শিবপ্রকাশকে কলকাতায় ঘাঁটি গাড়তে নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্তরের নেতারা। যার অর্থ, ভোটের আগে কার্যত বঙ্গ বিজেপি-র দখল নিয়ে নিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
প্রসঙ্গত, শিবপ্রকাশ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের দায়িত্বে। দিল্লির সদর দফতর থেকে তিনটি রাজ্যেই তিনি ভাগাভাগি করে সময় দিতেন। কিন্তু তাঁকে বলা হয়েছে, এখন থেকে কলকাতাতেই বেশি সময় থাকতে হবে। পশ্চিমবঙ্গকে অগ্রাধিকারের তালিকায় একেবারে উপরে রাখতে হবে। বাংলার সংগঠনে যে দলাদলি ইত্যাদি রয়েছে, তার মোকাবিলা করে সময় পেলে যেন তিনি উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডে সময় দেন।
বুধবার সন্ধ্যায় আচমকাই বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডার এক বিবৃতিতে জানানো হয়, পশ্চিমবঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) হিসেবে অমিতাভ চক্রবর্তীকে নিযুক্ত করা হচ্ছে। অর্থাৎ, সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ওই পদে-থাকা সুব্রত চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁকে অন্য কোনও পদেও দেওয়া হচ্ছে না। যার অর্থ, তাঁকে আবার সঙ্ঘেই ফিরে যেতে হবে।
তাঁকে যে সঙ্ঘ এমন আচম্বিতে সরিয়ে দেবে, সেটা সুব্রত নিজেও জানতেন না। কোনও ধারণা ছিল না রাজ্য সভাপতি দিলীপেরও। বুধবার বিকেলে যখন সুব্রত অপসারণের খবর আসে, তখনও তিনি দিলীপের রাজারহাটের বাড়িতে একটি দলীয় বৈঠকে সভাপতিত্ব করছিলেন। রাজ্য বিজেপি-র আসন্ন বিজয়া সম্মিলনী নিয়ে ওই বৈঠকে ছিলেন দিলীপ, অরবিন্দ মেনন এবং শিবপ্রকাশ। অমিতাভর নিয়োগ তথা সুব্রতের অপসারণের খবর আসার পরেই দিলীপ বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যান।
আরও পড়ুন: কাল শাহের সঙ্গে বৈঠক ধনখড়ের, তার পর টানা এক মাস দার্জিলিঙে রাজ্যপাল
দলীয় সমীকরণে সুব্রত ছিলেন দিলীপের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এতটাই যে, ইদানীং তিনি দিলীপের রাজারহাটের বাড়িতেই থাকতেন। তাঁকে নিয়ে দলের দিলীপ-বিরোধী অংশের ঘোরতর আপত্তি ছিল। অভিযোগ ছিল, দিলীপ-সুব্রত জুটি দলকে কব্জা করে ফেলছেন। যে কারণে সুব্রতর অপসারণের পর দলের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে এক নেতা খোলাখুলিই লেখেন, ‘শনির দশা কাটল’। বস্তুত, সুব্রতকে সরিয়ে অমিতাভকে নিয়োগ করায় দিলীপ-বিরোধী শিবিরে (কৈলাস, মুকুল রায়, বাবুল সুপ্রিয়, স্বপন দাশগুপ্ত ইত্যাদি) উল্লাস শুরু হয়ে যায়।
কিন্তু পরে জানাজানি হয় যে, সুব্রতকে সরানোর পাশাপাশিই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কৈলাসকেও আপাতত পশ্চিমবঙ্গ থেকে মধ্যপ্রদেশে বেশি মনোনিবেশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁকে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রদেশের ভোট পর্যন্ত সেখানেই থাকতে। তিনি তা না-মানলে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কারণ, কৈলাস দলের মধ্যে একটি বিশেষ উপদলের হয়ে কাজ করছেন। যদিও কৈলাসের বিষয়টি আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই বার্তাই দিয়েছেন যে, সুব্রতকে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, দিলীপ-বিরোধী গোষ্ঠীর হাতে বেশি ক্ষমতা দেওয়া হল। উল্টে তাদের নেতাকেও ‘সবক’ শেখানো হল।
আরও পড়ুন: ক্ষমতার ‘অপব্যবহার’, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সাসপেন্ড করলেন রাষ্ট্রপতি
কিন্তু এই দুই সিদ্ধান্তের চেয়ে আরও বহুগুণ ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ হল শিবপ্রকাশকে রাজ্য দলের মাথায় বসিয়ে দেওয়া। যা থেকে এই বার্তা খুব স্পষ্ট যে, বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্য বিজেপি-র অন্দরে যে গোষ্ঠীলড়াই চলছে, তার মোকাবিলায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। যা কার্যত রাজ্যদলের ‘দখল’ নেওয়া। এমন ঘটনা এ রাজ্যের রাজনীতিতে এর আগে একবারই ঘটেছে। তা-ও সাতের দশকের প্রথমদিকে। যখন সিপিএমের রাজ্যনেতাদের মাথায় পলিটব্যুরোর একজন শীর্ষনেতাকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই ‘শুদ্ধকরণ’-এর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে অবশ্য জোরাল পটভূমিকা রয়েছে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ এবং পরিবারের শীর্ষস্থানীয়রা মনে করেন, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখলের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে বিজেপি-র। কিন্তু রাজ্যের দুই বিবদমান শিবিরের নেতারা নিজেদের মধ্যে অনবরত লড়াই করে সেই সম্ভাবনা নষ্ট করে ফেলছেন। সেই কারণে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ জরুরি।
আরও পড়ুন: দেশে করোনা আবহে প্রথম ভোটে উঠল স্বাস্থ্যবিধি ভাঙার অভিযোগ
এর আগে রাজ্যের বিবদমান দুই গোষ্ঠীর নেতারা যখন অমিত শাহের সঙ্গে দিল্লিতে দেখা করেছিলেন, তখন দুই শিবিরকেই বার্তা দিয়েছিলেন দলের এই শীর্ষনেতা। একদিকে যেমন তিনি স্বপনকে বলেছিলেন, তাঁর মতো পণ্ডিত মানুষের এমন দলীয় কোন্দলে জড়ানো মানায় না, তেমনই বাবুলকেও বলেছিলেন, তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এবং তিনি সকলেরই মন্ত্রী।বাবুল তিনি কেন দলের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন! স্বপন-বাবুল দু’জনেই ওই কথোপকথনের কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁদের দাবি, তেমনকিছু আদৌ ঘটেনি। কিন্তু বিজেপি-র শীর্ষনেতৃত্বের খবর, তাঁদের তরফে দু’জনকেই রাজ্য দলের কোন্দল থেকে সরে থাকার স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছিল। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, তার পর থেকে স্বপন-বাবুল দু’জনেই ‘সংযত’ হয়ে যান। দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, ‘‘ওঁরা বুদ্ধিমান। তাই সংযত হয়ে গিয়েছিলেন।’’
অন্যদিকে, ওই সময়েই দিলীপকেও সতর্ক করেন অমিত শাহ। তাঁকে বলা হয়, তিনি রাজ্য সভাপতি। ফলে সকলের নেতা। তাই তাঁকে সকলকে নিয়েই চলতে হবে।
কিন্তু তার পরেও লড়াই থামেনি। যার প্রভাব পড়ে পুজোর সময় প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল পুজো উদ্বোধনের কর্মসূচিতে। তার কাছাকাছি সময়েই যুবমোর্চার জেলা কমিটি গঠন নিয়ে সৌমিত্র খাঁ-দিলীপের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। সৌমিত্রর ঘোষিত সমস্ত কমিটি ভেঙে দেন দিলীপ। যার পাল্টা হিসেবে সৌমিত্র জানান, তিনি যুবমোর্চার সভাপতি পদে ইস্তফা দেবেন। ওই ঘোষণা করে দলের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়ে বেরিয়ে যান। ঘন্টা পাঁচেকের মধ্যেই তিনি আবার গ্রুপে ফিরে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। কারণ, দিলীপ এবং সৌমিত্র উভয়েই পরস্পরের বিরুদ্ধে চাঁছাছোলা ভাষায় বিবৃতি দিয়েছেন। যার ফলে মোদীর কর্মসূচি প্রচার থেকে হারিয়ে গিয়ে সামনে চলে এসেছে বিজেপি-র ভিতরের লড়াই। বিজেপি নেতৃত্ব ভেবেছিলেন, গোটা পুজো জুড়ে মোদীর পুজো উদ্বোধনের রেশ থাকবে। কিন্তু দুই নেতার লড়াইয়ের ফলে সংবাদমাধ্যমে তা কোনও দাগই কাটতে পারেনি।
গোটা ঘটনায় প্রবল রুষ্ট হন মোদী এবং অমিত শাহ। তার পরেই তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে সরাসরি হস্তক্ষেপের কথা ভাবতে থাকেন। প্রসঙ্গত, সুব্রতকে নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে নানা অভিযোগ ছিল। তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার এক নেতার সঙ্গে এলপিজি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আবার এক শ্লীলতাহানির ঘটনায় তাঁকে বেশ কয়েকবার ডেকে জেরাও করেছিল কলকাতা পুলিশ। দলের ভিতরেও তাঁকে নিয়ে নানা ক্ষোভ ছিল। ওই সব ঘটনার প্রেক্ষিতেই সুব্রতকে ডেকে সতর্ক করেছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা বি এল সন্তোষ। সূত্রের খবর, সুব্রত একটু বেশিই আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়েছিলেন। রাজ্য বিজেপি-র এক প্রথমসারির নেতার কথায়, ‘‘উনি যদি বিষয়গুলো মেনে নিতেন, তা হলে তাঁকে সতর্ক করে প্রথমবারের মতো ছেড়ে দেওয়া হত। কিন্তু উনি তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই মানতে চাননি। ফলে পত্রপাঠ তাঁকে বিদায় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।’’
আরও পড়ুন: ২০২১-এ ভারতের বাজারে অক্সফোর্ডের টিকা, জানালেন সিরামের প্রধান
ওই নেতা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, একই ঘটনা ঘটেছিল রাহুল সিন্হার ক্ষেত্রেও। তাঁর বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অভিযোগ পৌঁছেছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে। তখন তাঁকেও ডেকেও সতর্ক করেছিলেন অমিত। কিন্তু রাহুল তাঁর নির্দেশের কিছু মানলেও অধিকাংশই মানেননি। ফলে শেষপর্যন্ত তাঁকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপসারণের পর রাহুল তৃণমূলে যাওয়ার একটা পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। যা শুনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দলের অন্দরেই জানিয়ে দেন, রাহুল তৃণমূলে যেতে চাইলে যেতে পারেন। তাঁদের কোনও আপত্তি নেই।
রাহুল অবশ্য এখনও অন্যত্র গিয়ে উঠতে পারেননি। তার মধ্যেই সুব্রতকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে, কৈলাসকে আপাতত মধ্যপ্রদেশে পাঠিয়ে বাংলা জয়ের লক্ষ্যে শিবপ্রকাশকে বঙ্গ বিজেপি-র মাথায় বসিয়ে রাজ্যের নেতৃত্বের রাশ হাতে নিয়ে নিলেন মোদী-শাহরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy