চলতি আর্থিক বছরের (২০২৪-২৫) জন্য প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচের হিসাব পেশ করল রাজ্য সরকার। সোমবার বিধানসভায় অর্থ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের পেশ করা ওই খরচের প্রস্তাব পাশও হয়ে যায় বিনা বাধায়। তার মধ্যে সামাজিক এবং লক্ষ্মীর ভান্ডারের খাতে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা করে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। কোনও একটি আর্থিক বছরের বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ হয়, তার চেয়ে বেশি খরচ হলে অতিরিক্ত সেই বরাদ্দ বিধানসভায় পাশ করাতে হয় সরকারকে। এ দিন সেই প্রক্রিয়ায় বিরোধী দল বিজেপির বিধায়ক তথা অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ীর অভিযোগ, একমাত্র অতি জরুরি প্রয়োজনে এমন খরচ করা শ্রেয়। তাঁর প্রশ্ন, এই খরচ হবে, তা আগে জানত না রাজ্য! যদিও চন্দ্রিমার পাল্টা দাবি, কেন্দ্র বরাদ্দ দিচ্ছে না বলেই অতিরিক্ত খরচের ভার নিতে হচ্ছে রাজ্যকে।
এ দিন চন্দ্রিমা অতিরিক্ত খরচের যে হিসাব পেশ করেছেন, তাতে ২০২৪-২৫ বছরে বাজেটের সংশোধিত হিসেবের থেকে দফতরগুলি মিলিয়ে প্রায় ১৯,৪৬৫ কোটি টাকা বেশি খরচ করেছে রাজ্য। গত বছরের (২০২৩-২৪) তুলনায় তা প্রায় ৪,২০০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে সামাজিক খাতে ৮৫৯৩ কোটি এবং লক্ষ্মীর ভান্ডারের খাতে ৬৮৮৯ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে উপভোক্তা সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে রাজ্যের দাবি। আরও নতুন প্রায় ৫ লক্ষ উপভোক্তার আবেদন যাচাই করে পদক্ষেপ হবে। এ সব ছাড়া স্বাস্থ্যে দু’হাজার কোটি, শিক্ষায় প্রায় ৩,৬০০ কোটি, জনস্বাস্থ্যে প্রায় ২,৩০০ কোটি, সড়ক ও জলের খাতে প্রায় ১৪০০ কোটি, পুলিশে ৫০০ কোটি টাকা-সহ একাধিক খাতে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে রাজ্যের। ঋণ পরিশোধ খাতেও কিছু অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত খরচের বোঝা প্রায় ২০,৯৩৩ কোটি টাকা।
এই প্রসঙ্গে বিধানসভায় হওয়া বিতর্কে অশোক বলেন, “অপ্রত্যাশিত বা দুর্যোগের মতো অতি জরুরি কোনও বিষয়ে অতিরিক্ত খরচ হতে পারে। তাই সরকারের সত্য প্রকাশ করা প্রয়োজন। জানানো দরকার, বাজেটে যা প্রতিশ্রুতি ছিল, সেই কথা রাখার সদিচ্ছা রয়েছে কি না। গত ১১ মাসে এই খরচ? কী এমন জরুরি ঘটনা ছিল? আর্থিক পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র বলা দরকার। সরকার কিসে কম খরচ করেছে, তা বলা হয়নি। কোনও ব্যাখ্যা নেই। বাজেট ব্যয়ের অতিরিক্ত ৬.২% খরচ করা হয়েছে।”
যদিও একদিকে শাসকদল তৃণমূলের বিধায়কেরা বিধানসভায় পাল্টা দাবি করেছেন, এই আর্থিক বছর বাজেটের অতিরিক্ত দু’দফায় মোট ৮৭,৭৬৩ কোটি টাকা খরচ পাশ করিয়েছে কেন্দ্রও, তেমনই কেন্দ্র বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ বন্ধ রাখার কারণেই রাজ্যকে তেমন পদক্ষেপ করতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন চন্দ্রিমা। তাঁর বক্তব্য, “অপ্রত্যাশিত তো বটেই—জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন, জলজীবন মিশন-সহ কেন্দ্রীয় অনুদানভুক্ত প্রকল্পগুলিতে বরাদ্দ দিচ্ছে না কেন্দ্র। সেই কাজগুলো তো থামিয়ে দেওয়া যায় না! আমরা বরং ১৩ হাজারের বেশি সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরি করেছি। আমাদের টাকা থেকে জলের সংযোগও দেওয়া হচ্ছে গ্রামের বাড়ি বাড়ি। পরিকাঠামো বা মূলধনী খাতেও খরচ করা হয়েছে। তাই অতিরিক্ত টাকা চাওয়া হয়েছে।” চন্দ্রিমার সংযোজন, “মোট ৯৪টি সরকারি প্রকল্প রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছর নতুন একটি করে প্রকল্প চালু হয়েছে। আমাদের দেখে অন্য রাজ্য শর্তসাপেক্ষে লক্ষ্মীর ভান্ডার চালু করেছে। আমাদের প্রকল্পে কোনও শর্ত নেই। একটা পরিবারে ১০টি মেয়ে থাকলে তাঁরা সবাই তা পাবেন।”
সরকারি সূত্র বলছে, ২০২০-২১ বছরে রাজ্যের বাজেটের চেয়ে অতিরিক্ত খরচ হয়েছিল ৩৩,০৩৭ কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালে ২৫ হাজার কোটি, ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে ২১ হাজার কোটি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে অতিরিক্ত খরচ হয়েছিল ১৫,২৬২ কোটি টাকা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)