রবীন্দ্রনাথের এমন সব ছবি আর বিশ্বভারতীর বাইরে দেখা যাবে না।
রবীন্দ্রনাথের আঁকা যে সব ছবি তাদের হেফাজতে আছে, দেশে বা বিদেশে প্রদর্শনীর জন্য সেগুলি আর পাঠাবে না বিশ্বভারতী!
প্রয়োজনে ওই ছবির ‘নকল’ সংশ্লিষ্ট জায়গায় প্রদর্শনীর জন্য পাঠাবে বিশ্বভারতী। তাঁর ৭৫তম প্রয়াণ দিবসে রবীন্দ্রভবনে আসল কিছু ছবির প্রদর্শনীর পরেই রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের শিল্পীদের ছবি সংরক্ষণশালায় বরাবরের জন্য রাখা থাকবে। তবে অত্যাধুনিক সংরক্ষণের পদ্ধতি মেনে ছবি সংরক্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে বিশেষ ভাবে তৈরি আধুনিক প্রদর্শশালায় আসল ছবির প্রদর্শন করার কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার বিশ্বভারতী সংসদ বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিশ্বভারতীর অস্থায়ী উপাচার্য অধ্যাপক স্বপন দত্ত বলেন, “অত্যাধুনিক এবং সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতি মেনে রবীন্দ্রনাথের ছবি সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের আসল ছবি দেশ-বিদেশে নিয়ে গিয়ে আর প্রদর্শনী না করার জন্য সিদ্ধান্তও হয়েছে। সেক্ষেত্রে বিশ্বভারতী আসল ছবির ডিজিটাইজড কপি পাঠাবে সংশ্লিষ্ট জায়গায়।”
রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলা নিয়ে মেতে ওঠেন তাঁর শেষ বয়সে।
প্রথম দিকে পাণ্ডুলিপির পাতায় কাটাকুটি ঢেকে দেওয়ার জন্য চলে উদ্দেশ্যহীন আঁকিবুকি। পরে সেই কাটাকুটিই একদিন হয়ে ওঠে বিমূর্ত ছবি। শিল্পজগতে বিচরণ, আগ্রহ এবং তাঁর সৃষ্টি চলে শেষ সতের বছর। বিমূর্ত অবয়ব, নারীমুখ থেকে নিসর্গ— ঘুরে ফিরে আসে তাঁর ছবিতে। রবি-ছবির বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কবির এমন ছবির সংখ্যা দু’হাজারেরও বেশি।
বিদেশে কবির প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী হয় ১৯৩০ সালে প্যারিসে।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, মাদাম দ্য নোয়াই-সহ বন্ধু-বান্ধব এবং অনুরাগীদের একান্ত চেষ্টায় সে চিত্র প্রদর্শনী সম্ভব হয়। প্রদর্শনীতে কবির ১২৫টি ছবি স্থান পায়। বলা হয় সেই প্রদর্শনীর পরই রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্পী সত্তার প্রকাশ ঘটে। বিদেশের মাটিতে কেউ কেউ তাঁর শিল্পের প্রশংসা করলেও দেশের কাগজে নানা বিরুপ মন্তব্য করা হয়। তাতে আঘাত পান কবি। নিজের ছবি নিয়ে তিনি রানী চন্দকে বলেছিলেন, “আমার সব ছবির ভাব কেমন যেন বিষাদ মাখা। হয়তো ভিতরে আছে আমার ওটা।” সেই বিষাদ-নীল ছড়িয়ে কবির বেশির ভাগ ছবির রঙে-রেখায়।
কাগজ ও রঙের মান খুব একটা মানের না হওয়ায় কবির অনেক ছবির অবস্থা এমনিতেই ভাল নয়। কোনও কোনও ছবির কাগজ এসেছে ময়লা কাগজের ঝুড়ি থেকে। সেক্ষেত্রে বিশ্বভারতীর এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন শিল্পীরা। বিশিষ্ট চিত্রকর সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় বিশ্বভারতীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘বার বার ছবি নিয়ে যাওয়া-আসায় ছবির আয়ু কমে যায়। বার বার ফ্রেমিং, মাউন্টিং-এ নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা থাকে। রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ ছবি কাগজে রয়েছে। সে দিক থেকে আশঙ্কা আরও বেশি। তাই বিশ্বভারতী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে স্বাগত জানাই।’’
এ দিনের সংসদ বৈঠকে ‘দেশে বিদেশে প্রদর্শনীর জন্য আনা নেওয়া করা’ ও ‘সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতির অভাব ও স্থানাভাব’-এর কারণে রবীন্দ্রভবনে ছবি নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটি ওঠে। আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশ্বভারতীর কর্ম সমিতিতে রাষ্ট্রপতি তথা পরিদর্শক প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রতিনিধি চিকিৎসক সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “অতীতে উপাচার্য অধ্যাপক রজতকান্ত রায়ের সময়ে তৎকালীন রবীন্দ্রভবনের ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা অধ্যাপক উদয়নারায়ণ সিংহ রবীন্দ্রনাথের একাধিক আসল ছবি নিয়ে দেশে এবং বিদেশে বহু প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন। আমরা আশঙ্কা করছি যে কোনও ভাবে দুর্ঘটনার কারণে নষ্ট হতে পারে ওই দুর্লভ ছবি। সেই সময়ে আপত্তি করেও কোনও লাভ হয়নি। তাই দেশে বিদেশে আসল ছবি না নেওয়ার প্রসঙ্গ এ দিনের বৈঠকে তুলেছি।”
সুশোভনবাবুর দাবিকে জোরাল সমর্থন জানান কোর্ট সদস্য তথা তিন সাংসদ ভোলা সিংহ, দিগ্বিজয় সিংহ এবং অনুপম হাজরা।
এ হেন বিষয়ের গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে, ছবির জন্য বিশেষ সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং বিশেষ প্রদর্শশালা নিয়ে কেন্দ্রের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও ওঠে। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথের জন্ম সার্ধ শতবর্ষে বিদেশের বহু জায়াগায় রবীন্দ্রনাথের আসল ছবি নিয়ে গিয়েছে বিশ্বভারতী। বিশ্বভারতীর একটি সূত্র জানাচ্ছে, তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রকের আবেদনে সাড়া দিয়ে বিশ্বভারতী আসল ছবি নিয়ে গিয়ে বিদেশে প্রদর্শনী করে। আর তাতেই ক্ষোভ ছড়িয়েছিল শিল্পী মহলে। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ির ছবি নিয়ে বই নিয়েও! কীভাবে বিশ্বভারতীর নিজস্ব প্রকাশনা থাকা সত্ত্বেও বাইরের প্রকাশনা থেকে রবি-ছবি প্রকাশ হয়ে চলেছে, এ দিনও সে নিয়ে জল্পনা চলে।
সূত্রের দাবি, সার্ধ শতবর্ষের পরে ছবি ফেরৎ আনা হলেও রবীন্দ্রভবনের স্ট্রং-রুমে যেভাবে রাখা হয়েছে ছবিগুলি, তাতে নষ্ট হয়ে যাওয়া আশঙ্কাও রয়েছে। বিশ্বভারতী সূত্রের খবর, ইতালি থেকে বিশেষ ভাবে তৈরি রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু ছবিতে ফ্রেম বসানো হয়েছে। আর তাতেই ছবি নষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা করছে কোনও কোনও মহল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্বভারতীর এক অধিকর্তা জানান, প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর সময়ে একবার কিছু ছবি দিল্লিতে প্রদর্শনীর জন্য পাঠানো হয়েছিল। ফেরত আসা ওই আসল ছবির মধ্যে একটি কম ছিল। পরে জানা গিয়েছিল, ইন্দিরা গাঁধীর অজ্ঞাতসারে তাঁর দফতরে কেউ একটি ছবি রেখে দিয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরে সেই ছবি ফেরত এসেছিল রবীন্দ্রভবনে।
২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে রবীন্দ্রভবনের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান শ্রীনিকেতনের অধিকর্তা অধ্যাপিকা সবুজকলি সেন।
সেই সময়ে কিছু ছবি নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল বিশ্বভারতী। ওই ছবির দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান কলাভবনের কিউরেটর সুশোভন অধিকারী। পরে ইতালি থেকে বিশেষজ্ঞরা এসে ছবি সংরক্ষণের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু বিষয়টি আর এগোয়নি। রবীন্দ্র-চিত্র বিশেষজ্ঞ সুশোভনবাবু এ দিন বলেন, ‘‘খুবই সাধু উদ্যোগ। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের ছবির সংরক্ষণে। শুধু বাইরে ছবি নিয়ে যাওয়ায় নিষেধ নয়, রবীন্দ্রভবনের ‘স্টোরেজ এরিয়া’র আধুনিকীকরণ দরকার। না হলে দুর্লভ ছবি সংরক্ষণ করা খুবই কঠিন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy