পুর-ক্লিনিকে রোগী দেখছেন গৌতমপ্রসাদ সরখেল। নিজস্ব চিত্র
মানুষের হাসপাতালে পশুর চিকিৎসার তোড়জোড় ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছে এ রাজ্য। এ বার দেখল মানুষের হাসপাতালে বসা পশু-চিকিৎসককে। যাঁর হাতে বেশ কিছু মানুষের ‘চিকিৎসা’ও হয়ে গিয়েছে!
ঘটনাস্থল: দক্ষিণ দমদম পুরসভার হাসপাতাল। অভিযোগ: সেখানকার এক ক্লিনিকে বসে এক পশু-চিকিৎসক দিব্যি রোগী দেখছেন! রাজ্যের সুপার স্পেশ্যালিটি সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএমে কুকুরের ডায়ালিসিস করানোর প্রস্তাব দিয়ে তৃণমূল বিধায়ক-চিকিৎসক নির্মল মাজি যে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন, তার রেশ না-কাটতেই নতুন অভিযোগটির জেরে যারপরনাই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্য ভেটেরিনারি কাউন্সিলের কর্তাদের মতে, এটা ফৌজদারি অপরাধের সামিল। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে পুর-কর্তৃপক্ষ অবশ্য অবিলম্বে ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।
দমদমের ওই হাসপাতালে এক বছর ধরে চলছে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ ক্লিনিক— সোম থেকে শনি, সকাল ন’টা থেকে দুপুর দু’টো। কিন্তু ক্লিনিকের যিনি একমাত্র চিকিৎসক, সেই গৌতমপ্রসাদ সরখেল এমবিবিএস নন। তিনি বিভিএসসি, অর্থাৎ পশু-চিকিৎসক। স্বাস্থ্য দফতরের পাস্তুর ক্লিনিকে জলাতঙ্কের টিকা তৈরির প্রক্রিয়ায় তিনি দীর্ঘ দিন যুক্ত ছিলেন।
এবং গত বছর অবসর নেওয়া ইস্তক গৌতমবাবু দক্ষিণ দমদম পুর হাসপাতালে অ্যান্টি-রেবিস ক্নিনিকের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। তিনি কার্ডে ওষুধ লেখেন। জলাতঙ্কের টিকা দেন। মানুষকে নানান ডাক্তারি পরামর্শও দিয়ে থাকেন। সোমবার সকালে ক্লিনিকে গিয়ে দেখা গেল, বাইরের বেঞ্চে জনা পনেরো রোগী, ভিতরের চেম্বারে ডাক্তারবাবু। ভেটেরিনারি পাশ করে মানুষের চিকিৎসা?
গৌতমবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘এখানে এমবিবিএস দরকার নেই। আমি-ই সামলাতে পারি। সব চিকিৎসা জানি।’’
বস্তুত এই কাজকে চিকিৎসাবিধির পরিপন্থী বলে আদৌ মনে করেন না গৌতমবাবু। ‘‘আমি ভেটেরিনারি ডাক্তার হলেও মানুষের ব্যাপারটা সব জানি। বহু দিন পাস্তুরে টিকা বানানোর কাজ করেছি।’’— দাবি তাঁর। এ-ও বলছেন, ‘‘আমি রয়েছি বলেই এত লোককে পাস্তুর যাওয়ার ঝক্কি পোয়াতে হচ্ছে না!’’ কিন্তু এটা একেবারে বেআইনি নয় কি?
নিজেকে ‘সমাজসেবী’ হিসেবে অভিহিত করে গৌতমবাবুর জবাব, ‘‘মানুষের সেবার চেয়ে ন্যায়-অন্যায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।’’
রাজ্য ভেটেরিনারি কাউন্সিলের কর্তারা যদিও ভিন্নমত। কাউন্সিলের সভাপতি মনোজিৎ তিওয়ারির পর্যবেক্ষণ, ‘‘পশু-চিকিৎসক কোনও ভাবেই মানুষের চিকিৎসা করতে পারেন না। এটা ফৌজদারি অপরাধ। পুলিশের হস্তক্ষেপ দরকার।’’ পাস্তুর ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা নীলরতন শিকদার, বেলেঘাটা আই়ডি’র অধ্যক্ষ উচ্ছ্বল ভদ্র কিংবা শম্ভুনাথ পণ্ডিতের সুপার সৌমাভ দত্তও এক সুর। ওই তিন হাসপাতালে পশু-পাখির কামড়-আঁচড় খাওয়া রোগীদের চিকিৎসা ও জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া হয়। এমবিবিএস বা এমডি ডিগ্রিধারীরাই কাজটা করেন। উচ্ছ্বলবাবুর কথায়, ‘‘আইন মোতাবেক, পশুর ডাক্তারেরা মানুষ রোগীর দেহ স্পর্শই করতে পারবেন না।’’
বৃত্তান্ত শুনে সুব্রত মৈত্র বা সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতো চিকিৎসকেরাও অবাক। সুব্রতবাবুর কথায়, ‘‘অ্যালোপ্যাথ, হোমিওপ্যাথ, আয়ুর্বেদ বা ইউনানির মতো স্বীকৃত পদ্ধতির ডিগ্রিধারীরাই শুধু মানুষের চিকিৎসা করার অধিকারী। ভেটেরিনারিরা নন।’’ সুকুমারবাবুর মন্তব্য, ‘‘হতে পারে, ওই ভদ্রলোক মানুষের চিকিৎসার ব্যাপারটা নিজের আগ্রহে শিখেছেন। তা বলে সেটা তিনি আইনত রোগীদের উপরে প্রয়োগ করতে পারেন না।’’
এসএসকেএমের কুকুর-কাণ্ডকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য দফতর ত্রুটি রাখেনি। তবে এ ক্ষেত্রে তেমন কিছু করেননি তৃণমূলচালিত দক্ষিণ দমদম পুর-কর্তৃপক্ষ। এ দিন বিষয়টি শুনে পুর-চেয়ারম্যান পাচু রায়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘গৌতমবাবু বোধহয় ওখানে কুকুরদের নির্বীজকরণের কোনও প্রকল্প দেখাশোনা করছেন। রোগী দেখছেন অন্য কেউ।’’ পাশে বসা এক অফিসার তাঁর ভুল শুধরে দিয়ে বলেন, ‘‘কোনও এমবিবিএস ওখানে নেই। গৌতম সরখেল-ই একমাত্র চিকিৎসক।’’
চেয়ারম্যান আর দেরি করেননি। অফিসারকে পত্রপাঠ নির্দেশ দেন, ‘‘এখনই নোটিস দিন। ক্লিনিক আপাতত বন্ধ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy