পদ্ধতি: সংগ্রহ করা হচ্ছে তসর গুটি। ছবি লেখকের সৌজন্যে
ঝাড়গ্রাম জেলার বেলপাহাড়ি, শিলদা, বাঁশপাহাড়ি, ভুলাভেদা রেঞ্জের বনভূমির শতকরা সত্তর বা কোথাও আশি শতাংশ শাল গাছে সমৃদ্ধ। শাল গাছের পাশাপাশি আছে মহুল, কেন্দ, সিধা, কুসুম, করংচ, অর্জুন, আসন এবং আরও হরেক রকমের গাছগাছালি। আছে নানান দুস্প্রাপ্য ভেষজ উদ্ভিদ। যেসব শুধু এই অঞ্চলেই পাওয়া যায়। ঝাড়গ্রাম বন বিভাগের অর্ন্তগত এই সব রেঞ্জের বনাঞ্চল রুক্ষ-পাহাড়ি আর দুর্গম। বনভূমি হরেক রকমের প্রাকৃতিক অমূল্য সম্পদ নিয়ে গঠিত। এ ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে বহু মানুষ এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন বারবার।
বনভূমির প্রাকৃতিক সম্পদকে আঁকড়ে ধরে জঙ্গলবাসী এবং জঙ্গল সংলগ্ন মানুষ বেঁচে রয়েছেন দীর্ঘ কয়েক দশক। এখানকার দরিদ্র মানুষদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নানান ভাবে বহু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিস্তর কাজও হয়েছে। এবং কিছুটা হলেও দরিদ্র মানুষগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নতিও হয়েছে। কিন্তু বনের প্রাকৃতিক সম্পদকে যথেচ্ছ ভাবে এই কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে বনের তথা পরিবেশের বেশ ক্ষতি হয়েছে। এবং আরও হতে চলেছে।
১৯৯৬ সালে জঙ্গলে শাল গাছে তসর গুটি চাষের পরিকল্পনা বন দফতর থেকে করা হয়েছিল। জঙ্গলের এবং এই পরিকল্পনার ভবিষ্যতের বাস্তবতার কথা চিন্তা না করেই বহু জায়গায় শুরু হয়েছিল চাষ। জঙ্গলের জমি, বন দফতরের খরচখরচা। শুধু শ্রমটাই বন সুরক্ষা কমিটির সদস্যদের। উদ্দেশ্য গ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বনজ সম্পদ রক্ষা করা।
তসর গুটি চাষ বড় শাল গাছে করার কিছু অসুবিধে রয়েছে। গুটিপোকা ১০-১২ ফুট লম্বা শাল গাছের মাথায় গুটি বাঁধে। ফলে ওই গুটি সংগ্রহ করা শ্রম সাপেক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রেই গাছের ক্ষতি হয়। আবার ছোট শাল গাছে তসর গুটি চাষ করলে তাতে ফলন ভাল হয় না। বেশির ভাগ গুটি নষ্ট হয়।
ফলে বন দফতরের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
এর পর কিছু জায়গায় সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় জঙ্গল সংলগ্ন এলাকার কিছু মানুষ শাল গাছে তসর গুটি চাষ করেন। কিন্তু তাঁরা গুটি পোকা সংগ্রহ করতে গাছ কেটে ফেলতে থাকেন। আবার অনেকে লম্বা শাল গাছ কেটে পাঁচ ফুট করে দেন। তসর গুটি চাষের জন্য গাছকে বনসাই করতে থাকায় তসর গুটি চাষে সুবিধে হয়। তসর গুটি চাষের জন্য দরকার নির্দিষ্ট দূরত্বে ছয় থেকে আট ফুট উচ্চতার ডালওয়ালা গাছ। যাতে পর্যাপ্ত সবুজ পাতা থাকবে। যত বেশি গাছ একই জায়গায় থাকবে এবং গাছের নীচের মাটি পরিষ্কার থাকবে তত বেশি এই চাষে লাভ। মূলত অর্জুন, আসন গাছে দক্ষিণবঙ্গে তসর গুটি চাষ করা হয়। বনভূমিতে একটানা কোথাও অর্জুন, আসন গাছ না থাকায় এবং বনভূমির মাটি আগাছা-ভেষজ উদ্ভিদ-লতাপাতায় পরিপূর্ণ থাকায় তসর গুটি চাষ লাভজনক নয়। আবার শাল গাছে তসর গুটি চাষও লাভজনক নয়। বন দফতর থেকে বেশ কিছু ফাঁকা বনভূমিতে একসময় তসর চাষের জন্য অর্জুন, আসন গাছের বাগান করা হয়েছিল। কিন্তু সাফল্যের ভাগ আশাপ্রদ নয় বলে তসর চাষ বনের জমিতে খুব আর হয়নি।
কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, কিছু বেসরকারি সংস্থা ঝাড়গ্রাম জেলার বেলপাহাড়ি, শিলদা, বাঁশপাহাড়ি, ভুলাভেদা, গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম রেঞ্জে বনভূমির জঙ্গল সংলগ্ন মানুষদের নতুন করে বন দফতরের জমিতে তসর গুটি চাষে উৎসাহিত করছে। তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তারা সরকারি-বেসরকারি নানান প্রকল্প থেকে সংগ্রহ করছে। কিন্তু বনভূমিতে উপযুক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ অনুমতি ছাড়া অ-বনায়নের কাজ (এ ক্ষেত্রে তসর গুটি চাষ) করা বা করতে উৎসাহিত করা বন সংরক্ষণ আইন অনুসারে অপরাধ। কোনও ক্ষেত্রেই তাঁরা বনভূমিতে উপযুক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেননি। বা হয়তো নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। শুধু তাই নয়, বন বিভাগের স্থানীয় কর্তৃপক্ষও এই ব্যাপারে উদাসীন। তাঁরা আজ অবধি তেমন কোনও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বলেই আজ বনাঞ্চলে কিছু জায়গায় রমরমিয়ে চলছে তসর গুটি চাষ। স্থানীয় প্রশাসন, পঞ্চায়েতের ভূমিকা বনভূমিতে তসর গুটি চাষের পক্ষেই।
বেশ কিছু জায়গায় দেখা যাচ্ছে, তসর গুটি চাষ লাভজনক করার জন্য বনভূমিতে অর্জুন, আসন গাছ রেখে শাল গাছ গোড়া থেকে কেটে ফেলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে যাতে শাল গাছের নতুন কাণ্ড না বেরোতে পারে তার জন্য গোড়া-সহ তুলে ফেলে হচ্ছে বা কিছু জায়গায় গোড়ায় কেরোসিন ঢেলে দিচ্ছেন চাষিরা। শুধু তাই নয়, বনভূমির উপর আগাছা-নানান ভেষজ উদ্ভিদ-নানান লতাপাতা পরিষ্কার করে নষ্ট করে দিচ্ছে বনের পরিবেশ ও বনজ সম্পদ। সৃষ্টি হচ্ছে ভূমিক্ষয়। হারিয়ে যাচ্ছে ওই অঞ্চলের বনের আর্কষণ। তৈরি হচ্ছে তসর গুটি চাষ ভূমি।
শিলদা রেঞ্জের শ্যামনগর, কুশভিলা, চাঁদাবিলা মৌজা, বেলপাহাড়ি রেঞ্জের ঘাঘরা, চড়কপাহাড়ি মৌজা, গোপীবল্লভপুর রেঞ্জের তারকি, ঝাউরি মৌজা-সহ বহু বনের মৌজাতে তসর গুটি চাষের জন্য বনভূমি এইভাবে জঙ্গল সংলগ্ন মানুষের কিছু অংশ এক বেসরকারি সংগঠনের মদতে এবং আর্থিক সহায়তায় ব্যবহার করছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে।
ওই সব বনভূমির মৌজায় এখন গেলে দেখা যাবে, ৫-৬ ফুট উচ্চতার বনসাই অর্জুন, আসন ইত্যাদি গাছ। শাল গাছ নেই। বন দফতর এক সময় তসর গুটি চাষে জঙ্গল সংলগ্ন মানুষদের উৎসাহ জুগিয়েছিল শাল গাছ কেটে বা বনের ক্ষতি করে নয়। কিন্তু এখন বেসরকারি সংগঠনের মদতে এবং আর্থিক সহায়তায় বনের শালগাছ ও নানান প্রজাতির উদ্ভিদ চিরতরে শেষ করে চলছে তসর গুটি চাষ। হয়তো আর কিছুদিন পরে বনের এই জমি চলে যাবে ওই কৃষকের হাতে চাষের জন্য, তাঁর রুজির জন্য।
জঙ্গল সংলগ্ন মানুষ বনের সুযোগ-সুবিধে অবশ্যই গ্রহণ করুন। কিন্তু সেটা নিশ্চয় বন ধ্বংস করে নয়। বনের পরিবেশ তথা বনজ সম্পদ নষ্ট করে নয়। শতাব্দী প্রাচীন শাল বৃক্ষ চিরতরে নষ্ট করে অর্জুন-আসন ইত্যাদি গাছ লাগিয়ে বা তাদের বনসাই করে কৃষিজমিতে পরিণত করা বেআইনি।
মনে রাখতে হবে আগামী দিনে মূল্যবান এই জঙ্গলই জঙ্গল সংলগ্ন মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। বিপদে কেউ পাশে না থাকলেও শাল, পিয়াল, মহুল, কুসুম, করংচ, কেন্দ, সিধা এই সব গাছ ও বনজ সম্পদ পাশে থাকবে। তাদের ফুল-ফল-পাতা-কাঠ-জ্বালানি-ছাতু-ধুনো-নানান ভেষজ ওষুধ আরও কত কী দিয়ে তাদের বিপদে পাশে দাঁড়াবে। জঙ্গল সংলগ্ন গুটিকয়েক মানুষের সুবিধের জন্য আর বেসরকারি সংস্থার মুনাফা লোটার জন্য এই অমূল্য বনজ সম্পদ নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।
লেখক প্রাক্তন বন আধিকারিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy