মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
জনপ্রিয় কিশোর সাহিত্য ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র জনপ্রিয়তর শ্রাব্য সংস্করণ শুরু হয়েছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘সপ্তদ্বীপের রাজামশাই’ গান দিয়ে। তবে সে নেহাতই ছেলেভোলানো গল্পকথা। বাস্তবের জমিতে শাসক তৃণমূলের ভিতরের কোন্দলে সারা বাংলা জুড়ে এমনই বিচ্ছিন্ন সাতটি ‘দ্বীপ’ তৈরি হয়েছে। রূপকথার সঙ্গে তার তফাত— প্রতিটি দ্বীপের ‘রাজামশাই’ আলাদা। বস্তুত, এক একটি দ্বীপে ‘রাজা’ একাধিক। সমস্যা সেখানেই।
দুয়ারে লোকসভা ভোট। তার আগে যখন তৃণমূলের মধ্যে ঐক্যের বাতাবরণ থাকার কথা, তখন দেখা যাচ্ছে কোথাও স্থানীয় রাজনীতির কোন্দলে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ছেন মন্ত্রী, কোথাও এলাকার যুবনেত্রীর সঙ্গে বিবাদে ভাঙচুর হচ্ছে দলীয় বিধায়কের কার্যালয়। পরিস্থিতি সামলাতে নামতে হচ্ছে পুলিশকে। কোথাও নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বে বিবৃতির লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছেন প্রথম সারির নেতারা। গত দু’সপ্তাহে রাজ্যে অন্তত এমন সাতটি এলাকা মাথা তুলেছে, যেখানে প্রকাশ্যে এসে পড়েছে শাসকদলের অন্দরমহলের দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্ব কোথাও আপাত ভাবে মিটেছে। কোথাও জারি রয়েছে।
বেশ কিছু এলাকায় তৃণমূলের সর্বোচ্চ স্তরের ‘মতান্তর’-এর ছাপ পড়ছে স্থানীয় স্তরে। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ‘নীরবতা’ জল্পনাকে আরও উস্কে দিচ্ছে। যদিও এই সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘দলে কিছু ইস্যু রয়েছে। কিন্তু তা মিটেও যাবে। ভোটের সময়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েই নামবে তৃণমূল। যার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যেখানে যা হচ্ছে তাতে লাগামও টানা হচ্ছে।’’ ঘটনাচক্রে, কুণাল নিজেও সাম্প্রতিক বিতর্কের অংশ হয়ে গিয়েছেন। দলীয় মুখপাত্র এবং রাজ্য সম্পাদক হিসেবে তিনি কিছু ‘ইস্যু’ যে রয়েছে, তা যেমন মেনে নিয়েছেন, তেমনই দাবি করেছেন এ সবই মিটে যাবে।
হাওড়া
রাজ্যের ক্রীড়া ও যুব কল্যাণমন্ত্রী মনোজ তিওয়ারির সঙ্গে হাওড়ার পুর প্রশাসক সুজয় চক্রবর্তীর পুরনো দ্বন্দ্ব রাস্তায় নেমে এসেছে। দু’জনের দ্বন্দ্বে হাওড়ার ক্রিসমাস কার্নিভ্যাল বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, অবিলম্বে কার্নিভ্যাল চালু করতে হবে। মনোজ-সুজয়ের বিবাদ মেটাতে হাওড়ায় ছোটেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। কিন্তু মেজাজ হারিয়ে অরূপের সামনেই সুজয়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে দেখা যায় মন্ত্রী মনোজকে। অরূপ অবশ্য বিষয়টি লঘু করতে চেয়ে বলেছিলেন, ‘‘পায়ে পা লেগে গিয়েছে।’’ বাস্তব হল, পায়ে পা দিয়েই ঝগড়া শুরু হয়েছিল। মনোজ-সুজয়কে দু’পাশে বসিয়ে ঐক্যের ছবি তুলিয়ে অরূপ বলতে চেয়েছিলেন, বিবাদ মিটে গিয়েছে। কিন্তু হাওড়া তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, বিবাদ মিটেছে। তবে ‘আপাতত’।
বলাগড়
হুগলি জেলার শেষ প্রান্ত বলাগড়। সেই বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সঙ্গে স্থানীয় নেত্রী তথা জেলা পরিষদের সদস্য রুনা খাতুনের বিবাদ চূড়ান্ত আকার নিয়েছে। চাপা বিবাদ প্রকাশ্যে চলে এসেছে। বিধায়কের ফেসবুক পোস্ট, দলের লোকেদের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশের মধ্যেই পাল্টা ময়দানে নামেন রুনা। ভাইরাল হয় বিধায়ক ব্যাপারীর ‘বিতর্কিত’ মুহূর্তের ছবি। রুনা সম্পর্কে কুরুচিকর পোস্ট করেন বিধায়ক। যার পরে বিধায়কের কার্যালয় ভাঙচুর হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে নামে বিরাট পুলিশ বাহিনী। বিধায়কের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন রুনা। আপাতত তৃণমূল খোদ বিধায়ককেই তাঁর এলাকায় ঢুকতে বারণ করে দিয়েছে। বলাগড় বিধানসভা হুগলি লোকসভার অন্তর্গত। যে লোকসভায় গত ২০১৯ সালে জিতেছিলেন বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্যায়। বলাগড় থেকেও এগিয়ে ছিল বিজেপি। ২০২১ সালে সেই বিধানসভা তৃণমূল ‘পুনরুদ্ধার’ করেছে বটে। কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে সেখানে দলীয় দ্বন্দ্ব তৃণমূলের জন্য ‘স্বাস্থ্যকর’ নয়।
উত্তর কলকাতা
১ জানুয়ারি তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা দিবসের দিনই ভিতরের বিতর্ক প্রকাশ্যে চলে আসে। একটি দলীয় মঞ্চ থেকে এলাকার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে দেশের রাজনীতিতে বাংলা ছাগলের তৃতীয় বাচ্চায় পরিণত হবে।’’ সুদীপ মঞ্চ ছাড়ার পরে সেখানে যান কুণাল। পরে তিনি বলেন, ‘‘সুদীপদা সামনে থাকলে ভাব সম্প্রসারণ করে বুঝিয়ে দিতাম।’’ সে দিনের মতো বিষয়টি মিটলেও তার পরের দু’দিন দফায় দফায় সুদীপের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানান বরাহনগরের বিধায়ক তাপস রায়। কখনও বলেন, ‘সুদীপ অনুৎপাদক সাদা হাতি’। কখনও বলেন, সুদীপের ‘জ্ঞান’ শুনে তিনি চলবেন না। বলেন, ‘‘উনি অভিনয় করলে অস্কার না পেলেও দাদাসাহেব ফালকে তো পেতেনই!’’ গোটা ঘটনাপ্রবাহে সুদীপ অবশ্য পাল্টা কোনও মন্তব্য করেননি। প্রকাশ্যে নীরবই থেকেছেন। তবে দলের সর্বময় নেত্রীর কাছে যে নিজের ‘অপমান’-এর কথা জানাননি, এমন কথা হলফ করে বলতে পারছেন না কেউ।
ব্যারাকপুর
ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে সাংসদ অর্জুন সিংহের সঙ্গে জগদ্দলের বিধায়ক সোমনাথ শ্যামের পুরনো দ্বন্দ্ব নতুন মোড়কে হাজির হয়েছে। সম্প্রতি একটি খুনের মামলায় অর্জুনের ভাইপো পাপ্পু সিংহের গ্রেফতারিতে যার সূত্রপাত। পরিস্থিতি সামলাতে অর্জুন-সোমনাথকে নিয়ে ‘মীমাংসা বৈঠক’ করতে কলকাতা থেকে নৈহাটি গিয়েছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। কিন্তু সোমনাথ বৈঠকে যাননি। সওয়া এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফিরতে হয় বক্সীকে। অর্জুন গত লোকসভায় বিজেপির হয়ে জিতলেও ২০২২ সালের অগস্টে তৃণমূলে ফেরেন। এর মাঝে সোমনাথ বিধায়ক হন ২০২১ সালে। সোমনাথ স্থানীয় স্তরে বরাবর অর্জুন-বিরোধিতার রাজনীতি করেছেন। অর্জুন বিজেপিতে যেতেই সোমনাথ যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলে। কিন্তু সাংসদ পুরনো দলে ফিরতে সোমনাথের সঙ্গে পুরনো দ্বন্দ্বও ফিরে এসেছে। যা লোকসভা ভোটের আগের আবহে শিল্পাঞ্চলের তৃণমূলকে প্রায় প্রতিদিন আলোড়িত করছে।
কোচবিহার
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল থেকে যাওয়া নিশীথ প্রামাণিককে কোচবিহার আসনটি তৃণমূলের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল বিজেপি। সেই কোচবিহারেই নবীন-প্রবীণ বিতর্কে মন্তব্য-যুদ্ধে জড়িয়েছেন উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের দুই স্তম্ভ উদয়ন গুহ এবং রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। উদয়ন মনে করেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর দলের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই। তাঁর মতো ওই বয়সে অত পরিণত নেতা কোনও দলে নেই।’’ আবার রবির বক্তব্য, ‘‘নবীনেরা আগে যোগ্য হয়ে উঠুক! তার পর তো তাদের হাতে দল ছাড়া হবে।’’ উদয়ন শিবিরের অভিযোগ, রবি আসলে অভিষেকের যোগ্যতাকে ‘অস্বীকার’ করতে চেয়েছেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই কোচবিহারে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল তৃণমূলের সংগঠনে কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে। লোকসভা ভোটের আগে এই মন্তব্যের লড়াই পরিস্থিতি ঘোরাল হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ইসলামপুর
রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা ইসলামপুরের বিধায়ক আব্দুল করিম চৌধুরী সরাসরি অভিষেককে ‘নাদান’ বলে কটাক্ষ করে বসেছেন! করিম বলেছেন, ‘‘নবীনদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া মানে বাঁদরের হাতে নারকেল দেওয়া।’’ তাঁর নিশানায় ছিলেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণালও। ইসলামপুর রায়গঞ্জ লোকসভার মধ্যে। যে লোকসভায় গত ভোটে জিতেছিল বিজেপি। তৃণমূল এখনও পর্যন্ত এক বারও রায়গঞ্জ লোকসভা জিততে পারেনি। তবে পাশাপাশি এ-ও ঘটনা যে, পঞ্চায়েত ভোটের আগেও করিম অনেক বাঁকাচোরা কথা বলেছিলেন। প্রভাব ফেলতে পারেননি। ফলে তাঁকে কেউ খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
বাঁকুড়া
কোন্দল এখনও প্রকাশ্যে এসে পড়েনি। কিন্তু বাঁকুড়া নিয়ে ‘উদ্বেগ’ আছে তৃণমূলের। বাঁকুড়ার নেতাদের তৃণমূল ভবনে বৈঠকে ডেকে সতর্কবার্তা শুনিয়েছেন রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। বাঁকুড়া তৃণমূলে দ্বন্দ্ব ছিলই। গত পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে জেলা পরিষদের সভাপতি কে হবেন, তা নিয়ে তিন গোষ্ঠীর মধ্যে চাপা রেষারেষিও ছিল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে জেলার দু’টি আসনই হারাতে হয়েছিল তৃণমূলকে। ২০২৪-এর ভোটের আগে সেই বাঁকুড়া আবার ভাবাচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্বকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy