Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
বোমা-গুলিতে রণক্ষেত্র কাটোয়া

তৃণমূল কর্মী খুনের পরে চড়ল পারদ

বোমার ধোঁয়া, গুলির শব্দ আর মোটরবাইকের আওয়াজ। যুদ্ধক্ষেত্র যেন! তার মধ্যে দিয়েই দৌড়চ্ছে লোকগুলো। কারও হাতে মাস্কেট, কেউ ওয়ান-শটার উঁচিয়ে। কারও মাথায় গামছা বাঁধা, কারও মুখ ঢাকা রুমালে। শনিবার ভোটের দিনটা এমনই কাটাল কাটোয়া। গুলিতে প্রাণ গেল এক তৃণমূল কর্মীর। সকাল ৮টা নাগাদ ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের পঞ্চবটীপাড়ায় একটি বুথের সামনে গোলাগুলি শুরু হয়। প্রথমে গুলিবিদ্ধ হন এক কংগ্রেস কর্মী।

ভোট-দুপুরে বন্দুক হাতে দাপাদাপি কাটোয়ার রাস্তায়। — নিজস্ব চিত্র।

ভোট-দুপুরে বন্দুক হাতে দাপাদাপি কাটোয়ার রাস্তায়। — নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
কাটোয়া শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৭
Share: Save:

বোমার ধোঁয়া, গুলির শব্দ আর মোটরবাইকের আওয়াজ। যুদ্ধক্ষেত্র যেন! তার মধ্যে দিয়েই দৌড়চ্ছে লোকগুলো। কারও হাতে মাস্কেট, কেউ ওয়ান-শটার উঁচিয়ে। কারও মাথায় গামছা বাঁধা, কারও মুখ ঢাকা রুমালে। শনিবার ভোটের দিনটা এমনই কাটাল কাটোয়া। গুলিতে প্রাণ গেল এক তৃণমূল কর্মীর।

সকাল ৮টা নাগাদ ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের পঞ্চবটীপাড়ায় একটি বুথের সামনে গোলাগুলি শুরু হয়। প্রথমে গুলিবিদ্ধ হন এক কংগ্রেস কর্মী। তার পরেই স্থানীয় তৃণমূল কর্মী ইন্দ্রজিৎ সিংহের (৩৪) কপালে ও পেটে গুলি লাগে। তৃণমূলের অভিযোগ, ইন্দ্রজিৎকে একা পেয়ে কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাঁর উপরে চড়াও হয়। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত বলে ঘোষণা করেন ডাক্তারেরা। বর্ধমানের পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল বলেন, ‘‘কংগ্রেসের কর্মীরা ওই তৃণমূল কর্মীকে গুলি করেছে বলে অভিযোগ। ওই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত তিন জনকে আটক করা হয়েছে। একটি পিস্তল বাজেয়াপ্ত হয়েছে।’’

এই খুনের পরেই কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় কাটোয়া শহর। মাস্কেট বাহিনীর দাপাদাপি, বোমাবাজি, ইভিএম ভাঙা, ভোটকর্মীর গাড়িতে হামলা, বুথ দখলের অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। গুলিতে জখম হন দুই মহিলা ভোটার-সহ পাঁচ জন। সারা দিনে ১৮ জনকে ধরেছে পুলিশ। সন্ধ্যায় বর্ধমানের জেলাশাসক তথা রিটার্নিং অফিসার সৌমিত্র মোহন জানান, আটটি বুথে পুনর্নির্বাচন হবে।

তৃণমূলের যদিও দাবি, অশান্তি যা হয়েছে তা পাকিয়েছে পুরসভায় ক্ষমতাসীন কংগ্রেসই। দলের বর্ধমান জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথের বক্তব্য, ‘‘কংগ্রেস সন্ত্রাস করেছে। আমাদের এক কর্মী খুন হয়েছেন। এ ছাড়া আর কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা নেই।’’ পক্ষান্তরে, স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক তথা এই পুরভোটেরও প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘তৃণমূলের বহিরাগতদের গুলিতেই ওই তৃণমূল কর্মী মারা যান। এখন আমাদের ঘাড়ে মিথ্যে দোষ চাপানো হচ্ছে।’’

স্থানীয় সূত্রের খবর, এ দিন বোমাবাজি শুরু হয় ভোর সাড়ে ৪টে থেকেই। সকাল ৬টা পর্যন্ত শহরের প্রায় সর্বত্র মোটরবাইকে চড়ে রাস্তায় বোমাবাজি করে দুষ্কৃতীরা। ভোট শুরুর পরে রেললাইন লাগোয়া এলাকার বুথ দখলের অভিযোগ ওঠে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে। তাদের ছোড়া গুলিতে এক সিভিক ভলান্টিয়ার আহত হন। এর পরেই দুষ্কৃতীরা শহরের ভিতরের দিকে এগোতে শুরু করে। হামলা হয় পঞ্চবটীপাড়ায়। ইন্দ্রজিতের মা সুষমা সিংহের অভিযোগ, ‘‘খুব সকালে বাড়িতে এসে কংগ্রেসের লোকেরা বেরোতে নিষেধ করেছিল আমাদের। ছেলে সে কথা শোনেনি!’’

ইন্দ্রজিতের মৃত্যুর খবর জানাজানি হতেই শুরু হয় ‘পাল্টা মার’। বিরোধীদের অভিযোগ, আসানসোল, দুর্গাপুর, পূর্বস্থলী ও নদিয়া থেকে বহিরাগতদের এনেছিল শাসক দল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কোথাও একটি গাড়ির সামনে-পিছনে দু’টি করে মোটরবাইক, কোথাও চারটি মোটরবাইকে চেপে বহিরাগতেরা দাপিয়ে বেড়ায়। বুথের সামনে গিয়ে বোমা-গুলি ছোড়ে তারা। ভয় পেয়ে ভোটারেরা পালালে দখল নেওয়া হয় সেই বুথের।

সকাল ১০টা থেকেই সুনসান হয়ে যায় শহর। বিরোধীদের অভিযোগ, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ চেষ্টা করেনি। কংগ্রেসের অভিযোগ, তাদের অফিসের সামনে বোমাবাজির সময়ে কয়েক জনকে ধরে ফেলে র‌্যাফ। কিন্তু পুলিশের কিছু অফিসার তাদের ছেড়ে দেন।

শেষমেশ দুপুরে খানিকটা সক্রিয় হতে দেখা যায় পুলিশকে। ভারতী ভবন স্কুলে বুথের সামনে দুষ্কৃতীরা গুলি চালালে পাল্টা শূন্যে গুলি ছোড়ে পুলিশ। দুষ্কৃতীরা পালায়। দুপুর আড়াইটে নাগাদ পুলিশের বড়-কর্তারা সেখানে পৌঁছলে এক পুলিশকর্মীকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমাদের কানের পাশ দিয়ে গুলি ছুটছে। হাতে বন্দুক নিয়ে বসে থেকে কী হবে? আপনারা নির্দেশ দিন।’’ এর পরেই তল্লাশি চালিয়ে কয়েক জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আটক করা হয় কিছু মোটরবাইক।

গত কুড়ি বছর ধরে কাটোয়া পুরসভায় ক্ষমতায় রয়েছে কংগ্রেস। দলের নেতা রবীন্দ্রনাথবাবুর ক্ষোভ, ‘‘এ বার বহিরাগতদের হামলা, বুথ দখলের আশঙ্কার কথা প্রশাসনকে বারবার জানিয়ে আসছিলাম। কিন্তু আমাদের জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী দেওয়া হয়নি। তার উপরে আজ যখন গোলমাল হল, তখনও পুলিশ সক্রিয় হয়নি।’’ পুলিশ সুপার অভিযোগ প্রসঙ্গে মুখ না খুললেও জেলা পুলিশের এক কর্তা মেনেছেন, ‘‘এখানে এই পর্যায়ের গোলমাল হবে ধারণা করা যায়নি। তেমন বুঝলে এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর জন্য আবেদন করতাম।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy