মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
গত শুক্রবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিনি ‘আমি’ নয়, ‘আমরা’য় বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করেন ‘টিমওয়ার্কে’। সোমবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে দিলেন, তৃণমূলে শেষ সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন!
উপনির্বাচনে জয়ী রাজ্যের ছয় তৃণমূল বিধায়ককে সোমবার বিধানসভায় শপথবাক্য পাঠ করান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। তার পরে বিধানসভার অন্দরে নৌসাদ আলি কক্ষে তাঁদের নিয়ে বৈঠক করেন মমতা। বৈঠকে ছিলেন তৃণমূলের অন্য বিধায়কেরাও। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই বৈঠকেই মমতা বিভিন্ন ‘জল্পনা’ এবং ‘গুজবের’ প্রতি ইঙ্গিত করে জানান, কে কী বলছে ভাবার দরকার নেই। যত দিন তিনি আছেন, তত দিন দলের বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন। অর্থাৎ, দলে ক্ষমতার দ্বিতীয় কোনও ‘ভরকেন্দ্র’ যে নেই, তা আরও এক বার দলের অন্দরে স্পষ্ট করে দিলেন মমতা।
মমতার সঙ্গে বিধায়কদের ওই বৈঠকে ছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি তথা রাজ্যসভার সাংসদ সুব্রত বক্সী, যে প্রবীণ নেতার সঙ্গে অভিষেকের সম্পর্ক খুব ‘মসৃণ’ নয় বলে দলের অন্দরে সকলেই জানেন। তবে বক্সী মমতার ‘আস্থাভাজন’। সূত্রের খবর, মমতা বিধায়কদের বৈঠকে বলেছেন, তিনি এবং বক্সী মিলে দল চালিয়ে নিতে পারবেন।
মমতার এই নির্ঘোষ অবশ্য একটি ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহের অঙ্গ, যা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তৃণমূলের অন্দরে চলছে। প্রথমে জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে মমতার দলের ‘নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব’ হাতে নেওয়া, জাতীয় কর্মসমিতিতে ‘প্রবীণ’ নেতাদের অন্তর্ভুক্তি (যে পাঁচ জনকে নেওয়া হয়েছিল, তাঁরা মমতার ‘আস্থাভাজন এবং অনুগত’ তো বটেই, প্রত্যেকেই অভিষেক-বর্ণিত বয়ঃসীমা পেরিয়ে গিয়েছেন), অভিষেক ‘দিল্লির মুখপাত্র’ কি না, তা নিয়ে দলের অন্দরে টানাপড়েন, বুধবার দিল্লিতে সংসদীয় বৈঠকে সংসদের অন্দরে তৃণমূলের অবস্থান নিয়ে অভিষেকের নির্দেশ এবং অতঃপর বৃহস্পতিবার মমতার বক্তব্য, সংসদীয় দলের অবস্থান কোনও ‘ব্যক্তিবিশেষ’ ঠিক করবেন না, ঠিক করবে সংসদীয় দল (সেই দলের সদস্যদের নামও স্থির করে দেন মমতাই)। সেই দল সিদ্ধান্ত নেবে। তার পরে তারা মমতার পরামর্শ নেবে। কারণ, মমতা বলেছিলেন, ‘‘আমিই সংসদীয় দলের চেয়ারপার্সন!’’
মমতার ওই বক্তব্য নিয়ে শাসক শিবিরের অন্দরে আলোচনা চলছিলই। তার রেশ কাটতে না কাটতেই গত শনিবার প্রকাশ্যে কিছু কথা বলেন অভিষেক, যা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
শনিবার নিজের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে চিকিৎসকদের নিয়ে একটি সম্মেলন করেছিলেন অভিষেক। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল আরজি কর-কাণ্ডের পরে চিকিৎসকদের সঙ্গে ‘সেতুবন্ধন’। সেই ভিন্ন প্রেক্ষিতেই অভিষেক তোলেন ‘আমি নয়, আমরা’ এবং ‘টিমওয়ার্কের’ প্রসঙ্গ। পাশাপাশিই বলেন, ‘‘জীবনে চ্যালেঞ্জ আসা ভাল। আমি স্থায়িত্বকে পছন্দ করি না। যদি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হন, তা হলে জীবনের মূল্য কী! সব কিছু যদি হাতের নাগালে চলে আসে, তা হলে উদ্দীপনা থাকে না।’’ পাশাপাশিই তিনি বলেন, “আবেগপ্রবণ হয়ে অনেক কথা বলে ফেললাম। আমি যা মনে করি সেটাই বলি। অনেকে আমায় বলেন, আমি ডিপ্লোম্যাটিক (কূটনীতিক) হয়ে কথাবার্তা বলতে পারি না। হয়তো তা-ই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, কাজ করে দেখাতে হবে।’’
অভিষেক কেন ওই বক্তব্য জানালেন, তা নিয়ে আলোচনা ছিলই। তার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বিধানসভায় মমতার বৈঠক এবং সেই বৈঠকে তিনি আরও এক বার ঘোষণা করেছেন, তিনি তৃণমূলের ‘চেয়ারপার্সন’। শেষ সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন।
বৈঠকে দলের ছাত্র এবং যুব সংগঠনেও রদবদলের ইঙ্গিত দিয়েছেন মমতা। তিনিই যে তৃণমূলের ‘চেয়ারপার্সন’, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মমতা জানান, যত দ্রুত সম্ভব তিনি তৃণমূলের ছাত্র-যুব সংগঠনকে নতুন করে সাজাবেন। ওই বৈঠকেই দলের বিধায়কদের বেশ কিছু নির্দেশ দেন তিনি। নির্দেশ দেন ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করে দিতে। বিধায়কদের বলেন, বিধানসভা ভোটের আগাম প্রস্তুতি হিসাবে তাঁরা যেন তাঁদের এলাকার প্রতিটি বাড়িতে যান। পাশাপাশি, সদ্যনির্বাচিত বিধায়কেরাও যেন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের ধন্যবাদ জানান। সংখ্যালঘু এবং তফসিলি ভোটারদের গুরুত্ব দেওয়ারও নির্দেশ দেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী।
ওই বৈঠকে বিধায়কদের ‘শৃঙ্খলাপরায়ণ’ হওয়ার কথাও বলেন মমতা। হুঁশিয়ারির সুরে জানিয়ে দেন, পর পর তিন দিন বিধানসভায় সময়মতো না-এলে চতুর্থ দিনে সেই বিধায়ককে ‘শো কজ়’ করা হবে। প্রকাশ্যে অভিষেককে উপমুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশমন্ত্রী করতে বলে বিধায়ক হুমায়ুন কবীর ইতিমধ্যেই দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে পড়েছেন। তাঁকে শো কজ়ও করা হয়েছে। তিনি দুঃখপ্রকাশ করে তার জবাবও দিয়েছেন। সেই আবহেই বিধায়কদের আরও এক বার শৃঙ্খলার পাঠ দিয়ে মমতা বলেছেন, দলের বাইরে কিছু বলার দরকার নেই।
বিধায়কদের বৈঠকে অন্য যে বিষয়টি দলের অভ্যন্তরে নজর কেড়েছে, তা হল অশোকনগরের বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামীকে দলনেত্রী মমতার নিজের ‘সীমানা’ চিনিয়ে দেওয়া। নারায়ণকে তিনি নিজের বিধানসভা এলাকার মধ্যে থেকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। দলের অন্দরে নারায়ণ ‘অভিষেক-ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত। শুধু তা-ই নয়, গত ১২ নভেম্বর ওই বিধায়ক প্রকাশ্য সভায় বলেছিলেন, ‘‘রাজনীতি চিরকাল এক জায়গায় থাকে না। আজ যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায়। তৃণমূল কংগ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। (স্বরূপনগরের এক নেতার উল্লেখ করে) আপনি হতে পারেন অনেক বড় জায়গায়। মাসখানেক কিন্তু। আর এক মাস। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দায়িত্ব নিয়েছে। বহু হনুমান-জাম্বুবানের ল্যাজ কাটা যাবে। এই ল্যাজকাটা বাঁদরের দল দেখবেন ঘুরবে।’’ তৃণমূলের অন্দরে খবর ছিল, নারায়ণের ওই বক্তব্য ‘সুনজরে’ দেখেননি মমতা। যে নারায়ণ ল্যাজ কাটার কথা বলেছিলেন, সোমবারের বৈঠকে তাঁরই ডানা ছাঁটার কথা বলেছেন স্বয়ং মমতা।
তিনি এবং বক্সীদা মিলে দল চালিয়ে নেবেন, নারায়ণকে তাঁর ‘সীমা’ সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া, দলে তাঁর নিজের পদাধিকার এবং কর্তৃত্ব (চেয়ারপার্সন) আরও এক বার ঘোষণা করে সকলকে সে সম্পর্কে অবহিত করে দেওয়া— সোমবারের বৈঠকে মমতা যে সমস্ত ‘বার্তা’ দিয়েছেন, তৃণমূলের অন্দরে তার ফল সুদূরপ্রসারী। একই সঙ্গে, তৃণমূলের অন্দরে এই বিবিধ বার্তা সম্ভবত পরের অঙ্কেরও সূচক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy