মনোরঞ্জন ব্যাপারী। — ফাইল চিত্র।
তিনি অহরহ সুর বদলান। কিছু দিন বিদ্রোহ। কিছু দিন বিনয়। আবার বিদ্রোহ। আবার বিনয়। ২০২১ সাল থেকে তৃণমূল বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সুর-বেসুর এবং তাল-বেতালে ‘বিড়ম্বিত’ হুগলি জেলার তৃণমূল নেতাদের একটা বড় অংশ। প্রকাশ্যে কিছু না-বলতে চাইলেও ঘরোয়া আলোচনায় ‘বিরক্তি’ গোপন করেন না। সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটের আগে সে বিরক্তি এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, জেলার নেতাদের একাংশ এখন থেকেই ভাবতে শুরু করেছেন, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে হুগলির বলাগড় থেকে মনোরঞ্জনকে আবার প্রার্থী না-করার বিষয়ে দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করবেন। প্রার্থী পছন্দের সুযোগ থাকলে তো কথাই নেই! যেমন বলেছেন এক প্রথম সারির নেতা, ‘‘ঘাড় থেকে নামলে বাঁচি!’’
জেলার নেতাদের একাংশের বক্তব্য, ২০২১ সালের ভোটে মনোরঞ্জনকে হুগলির বলাগড়ে ‘চাপিয়ে দেওয়া’ হয়েছিল। দূরত্বের সূত্রপাত সেখান থেকেই। আবার এ-ও ঠিক যে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের নিরিখে বলাগড়ে যত ভোটে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল, তাতে সেখানে মনোরঞ্জনের বদলে অন্য কাউকে প্রার্থী করা হলে কী হত, তা বলা মুশকিল! যদিও জেলার রাজনীতিতে মনোরঞ্জনের বিরোধীদের বক্তব্য, স্থানীয় প্রার্থী দাঁড় করালে জেতা যেত। কারণ, লোকসভা ভোটে মানুষের বিজেপির প্রতি যে ‘মোহ’ তৈরি হয়েছিল, তা দু’বছরের মধ্যে ঘুচে গিয়েছিল। মনোরঞ্জনের বলাগড় বিধানসভা হুগলি লোকসভার অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালে হুগলি থেকে সাংসদ হয়েছিলেন বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্যায়। লোকসভার নিরিখে বলাগড় বিধানসভায় বিরাট ব্যবধানে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। ফলে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পদ্মশিবিরের আশা ছিল বলাগড় জয়ের। কিন্তু দলিত সাহিত্যিক মনোরঞ্জনকে প্রার্থী করে চমক দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রিকশা চালিয়ে তাঁর প্রচার সাড়া ফেলেছিল গঙ্গাপারের মহল্লায়।
কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বলছে, বিধায়ক হওয়ার পরে গত দু’বছরে জেলার নেতৃত্ব থেকে অনেকটাই দূরত্ব তৈরি হয়েছে মনোরঞ্জনের। যা থেকে এই মর্মে কৌতূহল তৈরি হয়েছে যে, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে কি মনোরঞ্জন প্রার্থী হতে পারবেন? হুগলি জেলার এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘দল এখন অন্য ধাঁচে চলছে। এখন প্রার্থী চূড়ান্ত হয় এজেন্সির সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে। পঞ্চায়েতে অন্তত সমিতি ও জেলা পরিষদ স্তরে তেমনই হয়েছে। তাই বর্তমান বিধায়ককে টিকিট দেওয়া হবে কি না, তা এখনই বলা মুশকিল।’’ অন্য এক নেতার বক্তব্য, প্রার্থী বদল হতেই পারে। হুগলি জেলারই উত্তরপাড়ার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ওই কেন্দ্রে পর পর তিনটি বিধানসভা ভোটে দল তিন জনকে প্রার্থী করেছিল। তিন জনেই প্রথাগত রাজনীতির বাইরের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিন জনই জিতেছিলেন। ২০১১ সালে জিতেছিলেন গায়ক অনুপ ঘোষাল। ২০১৬ সালে জিতেছিলেন সাংবাদিক প্রবীর ঘোষাল। ২০২১ সালে জিতেছেন অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিক।
ভোটে জেতার কয়েক মাস পর থেকেই ব্লক নেতাদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছিলেন মনোরঞ্জন। সময় যত এগিয়েছে, ততই ব্লক ও জেলা তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে সংঘাত তীব্রতর হয়েছে দলীয় বিধায়কের। তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না। সরাসরি বলেছিলেন, ‘‘টাকার বিনিময়ে দল চলছে।’’ মনোরঞ্জন একটা সময়ে সরব ছিলেন নিয়োগ দুর্নীতিতে জেলবন্দি বহিষ্কৃত যুব তৃণমূল নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও। হুগলির জিরাট কলেজে ঢুকে শান্তনুর ছবি খুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
তবে মনোরঞ্জনের প্রসঙ্গে রাজনীতির বাইরের লোকদের নিয়ে ‘রাজনীতিক’ নেতাদের একটা ধারণাও তৈরি হয়েছে জেলা তৃণমূলের অন্দরে। জেলা তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘রাজনীতির বাইরের লোকেদের নিয়ে এই মুশকিল! তাঁরা নিজেদের বিশাল কিছু ভাবেন। মাটির বাস্তবতা থেকে তাঁরা অনেক দূরে থাকেন।’’ তবে পাশাপাশিই জেলা তৃণমূলের এক শ্রমিক নেতা বলেছেন, ‘‘উনি যে ব্যক্তিগত ভাবে সৎ, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনীতি তো আর সেবামূলক সংগঠন নয়। রাজনীতিতে অনেক সমীকরণ থাকে। সেগুলো অস্বীকার করলে রাজনীতিকেই অস্বীকার করা হয়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘মনোরঞ্জন দলের কাঠামোর ঊর্ধ্বে উঠে নিজের বিপণন করতে চান। যাঁরা প্রাণপাত পরিশ্রম করে দল করেন, তাঁরা কেন সেটা মেনে নেবেন! উনি কানে দেখে আবোলতাবোল মন্তব্য করেন। আর তার দায় এসে পড়ে দলের ঘাড়ে।’’
মনোরঞ্জন নিজের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দলের অন্দরে জানানোর চেয়ে ফেসবুকের দেওয়ালেই জানান বেশি। যা থেকে মনে হয়, তিনি তাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। পঞ্চায়েত ভোটের আগে ফেসবুকে তিনি ‘বিক্ষুব্ধ’ ছিলেন। ভোট মিটতেই সুর বদলে ফেলেছেন। যা দেখে রসিকতা করে অনেকে তাঁর সঙ্গে শিল্পী শুভাপ্রসন্নের তুলনা করতে শুরু করেছেন। যদিও মনোরঞ্জন নিজে বলছেন, বিষয়টা তেমন নয়। আনন্দবাজার অনলাইনকে মনোরঞ্জন বলেন, ‘‘কেউ আমাকে কারও সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে আমি কী করতে পারি!’’
গত মাসে জেলা তৃণমূলের পঞ্চায়েত নির্বাচনের কমিটির সদস্য ও রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন মনোরঞ্জন। ফেসবুকেই। সেই সঙ্গে এ-ও বলেছিলেন, ২০২১ সালে ভোটে দাঁড়ানোর সময় তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। তার পর দু’বছর ধরে পঞ্চাশ বার ছোটাছুটি করেও পেনশন চালু হয়নি। পাননি গ্র্যাচুইটির টাকাও। পেনশন চালু হলেই বিধায়ক পদ ছেড়ে দেবেন। পঞ্চায়েত ভোটে তাঁর যে সব অনুগামী দলের প্রতীকে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা জিতেছেন। তাঁর কিছু অনুগামী যাঁরা দলের টিকিট না-পেয়ে নির্দল হয়ে লড়াই করেছিলেন, তাঁরা হেরেছেন! সামগ্রিক ভাবে বলাগড় ব্লকে তৃণমূলের ফল ভাল হয়েছে পঞ্চায়েতে। কুন্তল ঘোষ, শান্তনুকাণ্ড, বিধায়ক-ব্লক সভাপতির কোন্দল প্রভাব ফেলেনি ভোটের ফলে।
পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর অতঃপর গত সোমবার একটি ফেসবুক পোস্টে বলাগড়ের তৃণমূল বিধায়ক লেখেন, ‘‘পুরাতন সব কিছু ভুলে যেতে চাই। নতুন কিছু শুরু করতে চাই। আমি কঠোর দরিদ্রজীবন দেখেছি প্রায় চল্লিশ বছর। শুধু জল খেয়ে পেটের যন্ত্রণা ভুলে সেই দিনগুলি আজও মনে পড়লে বুকে ব্যথা মোচড় দিয়ে ওঠে।’’ কিন্তু নতুন কী শুরু করবেন? জবাবে তৃণমূল বিধায়ক বলেন, ‘‘অনেক কিছু তো করলাম! এ বার একটু নাটক করব। দাবা খেলব।’’ ২১ জুলাই ধর্মতলার সভামঞ্চে যাবেন? জবাবে মনোরঞ্জন বলেন, ‘‘কেন যাব না? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কাছে ভগবান। তাঁর আদেশই আমার কাছে শেষকথা।’’
তিনি এত দিন নাটক করেছেন কি না, তা বলতে পারবেন হুগলি জেলার নেতারা। কিন্তু তাঁদের মতে, পঞ্চায়েতের ফলাফলের পর রাজনীতির দাবাখেলা আবার শুরু করে দিয়েছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। যার চাল তাঁকে ২০২৬ সালের ভোটে বলাগড়ের টিকিটের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy