চলে গেলেন ছোট আঙাড়িয়া কাণ্ডের প্রধান সাক্ষী। ফাইল চিত্র
২০০১ সালের জানুয়ারিতে ঘটেছিল ছোট আঙাড়িয়া কাণ্ড। সদ্য জন্ম নেওয়া পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতার এই গ্রামের একটি বাড়িতে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ তৃণমূল কর্মীর। ২০ বছর পরেও সেই তদন্ত শেষ হয়নি। তারই মধ্যে রবিবার মৃত্যু হল সেই মামলার প্রধান সাক্ষী বক্তার মণ্ডলের। তাঁরই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া তৃণমূল কর্মীদের খুন করায় অভিযুক্ত ছিল সিপিএম। প্রথমে বক্তারের সাক্ষ্যেই অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়ে যান। পরে তিনিই আবার আদালতে জানান ভয়ে মিথ্যা সাক্ষ্যদানের কথা। শেষে এক বার হাল ছেড়ে দেওয়া ছোট আঙাড়িয়া তদন্ত নতুন করে আবার শুরু করে সিবিআই। কিন্তু তা শেষ হয়নি এখনও। দু’দশক আগে রাজ্য রাজনীতির অন্যতম চরিত্র হয়ে ওঠা বক্তার রবিবার প্রয়াত হলেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। বাজার থেকে বাড়ি ফিরে অসুস্থ বোধ করেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মৃত্যু হয় তাঁর।
ছোট আঙাড়িয়া কাণ্ডের পরে বক্তারকে সুরক্ষা দিতে উদ্যোগ নিয়েছিল তৃণমূল রাজ্য নেতৃত্ব। দীর্ঘ সময় তিনি কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বাড়িতে কী হয়েছিল ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি? কী ভাবে মৃত্যু হয় মোক্তার খাঁ, রবিয়াল ভাঙি, হায়দার মণ্ডল, মুক্তো পাত্র, জয়ন্ত পাত্রর? বক্তার রাজ্যে পালাবদলের পরে মেদিনীপুর আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে যা বলেছিলেন, সেটিই ছিল তৃণমূলের বরাবরের অভিযোগ।
বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে। অভিযোগ, ওই হামলায় গুলিও চলে। যাতে ওই গ্রামের বাসিন্দা পাঁচ তৃণমূল কর্মী মারা যান। আঙুল ওঠে তদানীন্তন শাসক সিপিএমের দিকে। তদন্ত যায় সিবিআইয়ের হাতে। কিন্তু তদন্তকারীদের দাবি অনুযায়ী, মূল সাক্ষী বক্তার-সহ অন্যেরা আদালতে ‘উল্টো’ সাক্ষ্য দেওয়ায় ২০০৯ সালে মামলা কার্যত ঠান্ডা ঘরে চলে যায়। বেকসুর খালাস হয়ে যান তপন ঘোষ, সুকুর আলি সহ অভিযুক্ত আট সিপিএম নেতা। তবে আরও পাঁচ অভিযুক্ত তখনও ফেরার ছিলেন। ২০১১ সালে রাজ্য ক্ষমতা বদলের পরে ওই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত দিল মহম্মদ গ্রেফতার হন। শুরু হয় নতুন করে তদন্ত। পুরনো সাক্ষ্য সঠিক ছিল না জানিয়ে নতুন করে আদালতে নিজেদের চোখে দেখা ঘটনার বিবরণ দেন বক্তার এবং তাঁর স্ত্রী আয়েষা মণ্ডল।
এই মামলায় প্রথম থেকে অভিযুক্ত ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের দুই সিপিএম নেতা তপন ঘোষ ও সুকুর আলি। মামলার গোড়া থেকে এই দুই সিপিএম নেতা পালিয়ে বেড়ালেও ২০০৭ সালে নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলাকালীন সেখান থেকে ফেরার পথে অস্ত্র-সহ দু’জন ধরা পড়ে যান পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায়। সিবিআই তাঁদের হেফাজতে নেয়। কিন্তু সাক্ষীরা বিরূপ হয়ে যাওয়ার সুবাদে ২০০৯-এর ২৮ মে তাঁরা ছোট আঙাড়িয়া মামলায় বেকসুর খালাস পেয়ে যান।
আদালতে যে বয়ান বক্তার দিয়েছিলেন, সেটিই ছোট আঙাড়িয়া কাণ্ডে তদন্তকারীদের কাছে বড় অস্ত্র। বক্তার জানিয়েছিলেন, ১৯৯৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে গড়বেতায় তৃণমূল ও বিজেপি-র প্রাধান্য ছিল। অনেকগুলি পঞ্চায়েতও ছিল তাদের দখলে। সিপিএম নেতারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। মাঝে-মাঝে গ্রাম দখল করতে এলেও ব্যর্থ হন তাঁরা। তখন তপন, সুকুর, দীপক সরকার (তৎকালীন জেলা সম্পাদক), সুশান্ত ঘোষ (রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী) জনযুদ্ধের (এখন মাওবাদী) সাহায্যে বন্দুক নিয়ে এলাকা দখল করেন। তৃণমূল কর্মীরা গড়বেতা শহরে পার্টি অফিসে আশ্রয় নেন। বক্তার আদালতে বলেছিলেন, “দীপক সরকার ও সুশান্ত ঘোষের নির্দেশে তপন-সুকুর, দিবাকর ভুঁইয়া, প্রশান্ত পালেরা প্রায়ই আমাদের সঙ্গে দেখা করতেন। বলতেন, ওদের ঝান্ডা নিয়ে ঘুরলে কেউ কিছু বলবে না। ওই আশ্বাসেই ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি দুপুর দেড়টা নাগাদ গড়বেতা থেকে হাঁটতে হাঁটতে ১৫ জন তিন ভাগে ভাগ হয়ে সন্ধে সাড়ে ৬টা-৭টা নাগাদ আমার বাড়িতে পৌঁছই। স্ত্রীকে চা বানাতে বলে পাশেই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। মা বলেন, সিপিএম-কে বলে এসেছিস? না হলে তোদের মেরে ফেলবে। মাকে আশ্বস্ত করে বাড়ি ফিরে আসি।” তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। আচমকাই বাইরে বহু মানুষের চিৎকার শুনতে পান বক্তার। সঙ্গে প্রচুর টর্চের আলো। কী হয়েছে দেখার জন্য বাড়ি থেকে বেরোতেই স্থানীয় বাসিন্দা নিয়ামৎ আলির সঙ্গে দেখা হয়।
বক্তার আরও বলেছিলেন, “নিয়ামৎ বলে তোরা পালা, তোদের মারতে আসছে। পালাব কী? দেখি, সিপিএমের লোকজন বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। আমি তখন পাশের বাঁশঝোপে লুকিয়ে পড়ি। বাঁশঝোপ থেকেই দেখছি, গোলাপ বলছে, ওদের পুড়িয়ে মেরে ফেল। প্রশান্ত বলছে, পেট্রোল দিয়ে আগুন লাগিয়ে দে। কেউ বেরোতে পারবে না। আমারই বাড়ির উনুন থেকে আগুন নিয়ে বাড়ির ৩-৪ জায়গায় আগুন লাগিয়ে দিল। আগুনের তাপে মোক্তার নেমে আসছিল। প্রশান্ত পাল তলোয়ার দিয়ে তার গলা কেটে দিল। বাড়ি লক্ষ্য করে গুলিও করে। আগুন থেকে বাঁচতে জানলা দিয়ে কেউ লাফ দিলেই তাকে লক্ষ্য করে ৩-৪ জন এক সঙ্গে গুলি চালাতে শুরু করছিল।” তপন ঘোষ, সুকুর আলি, দিবাকর ভুঁইয়া, গোলাপ, ভোলা, দিল মহম্মদ, সিরাজুল, সালেমৎ-সহ বেশ কিছু সিপিএম নেতা এই হত্যা চালিয়েছিলেন বলে বক্তার আদালতে জানান। সঙ্গে জানিয়েছিলেন, ঘটনার সময়ে ওই বাড়িতে তাঁর সাত ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী-ও ছিলেন। তাঁরা অবশ্য অক্ষত ছিলেন। বক্তার বলেন, “আমার বাড়ির ঠিক পিছনেই শ্বশুরবাড়ি। ওরা গিয়ে সেখানে ঢুকে পড়ে। আমার ছোট মেয়ে নিলোফার যাওয়ার সময় মোক্তারের কাটা মুণ্ডুতে পা লেগে পড়ে যায়।’’
যাঁদের বিরুদ্ধে বক্তার সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন, তাঁদেরই একজন সুশান্ত ঘোষ রবিবার মৃত্যুর খবর পেয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। বলেন, ‘যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। প্রকৃতির নিয়মে সবাইকে যেতে হবে। তবে ছোট আঙাড়িয়া মামলায় প্রথমে যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল আদালতে তাঁরা বেকসুর খালাস হন। পালাবদলের পর রাজনীতির প্রতিহিংসায় আবার গ্রেফতার হয়েছেন এক জন। আদালতে মামলা চলছে।’’
ছোট আঙাড়িয়া বরবারই রাজ্য রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। ফি বছর ৪ জানুয়ারি ওই গ্রামে শহিদ দিবস পালন করে তৃণমূল। গত বছরেই সদ্য বিজেপি-তে যোগ দেওয়া শুভেন্দু অধিকারী পাল্টা সমাবেশ করেছিলেন। কিন্তু এ বার একাই কর্মসূচি নেয় তৃণমূল। রবিবার বক্তারের মৃত্যুর খবর পেয়েও গ্রামে গিয়েছেন তৃণমূল ব্লক সভাপতি সেবাব্রত ঘোষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy