দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে ভোটার তালিকার ‘স্ক্রুটিনি’ শুরু করেছিলেন তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি। আচমকা দেখলেন, তাঁর নিজের নামের উপরেই ‘ডিলিটেড’ সিলমোহর। ভোটার তালিকায় ‘বিরাট অনিয়ম’-এর অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনকে মঙ্গলবার সকালেও তুলোধনা করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তার মাঝেই বাঁকুড়ার ভোটার তালিকায় এমন কাণ্ডের হদিস মেলায়, আরও চড়েছে বাংলার শাসকদলের সুর। রাজ্য বিজেপির সভাপতির কেন্দ্র বালুরঘাটেও ভোটার পরিচয়পত্রে অনিয়মের অভিযোগ তুলে তৃণমূল মঙ্গলবার সরব হয়েছে। বিজেপি সভাপতির জবাব, ‘‘রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক তো মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশেই নিযুক্ত হন।’’
বাঁকুড়া-২ ব্লকের জুনবেদিয়া অঞ্চল তৃণমূলের সভাপতি অলোককুমার কুন্ডু মঙ্গলবার সকালে নিজের এলাকায় দলীয় কর্মীদের নিয়ে ‘স্ক্রুটিনি’র কাজে বেরিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ব্লক তৃণমূলের সভাপতি বিধান সিংহও ছিলেন। তৃণমূলের দাবি, ভোটার তালিকার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে নিজের নামের দিকেও অঞ্চল সভাপতির নজর পড়ে। তাঁর নামের উপরে ‘ডিলিটেড’ লেখা রয়েছে দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান। অলোকের কথায়, ‘‘আমি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বহু নির্বাচনে আমি প্রিসাইডিং অফিসার কাজ করেছি। আমি জানি, কোনও ব্যক্তির মৃত্যু হলে অথবা বিয়ে বা অন্য কারণে বাসস্থান পরিবর্তন হলে নির্দিষ্ট আবেদনের ভিত্তিতে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়। আমার তো মৃত্যু হয়নি। বাসস্থানও পরিবর্তন করিনি। তাই ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার আবেদন করারও প্রশ্ন ওঠে না।’’ তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতির দাবি, ‘‘বিজেপি ষড়যন্ত্র করে কিছু সরকারি আধিকারিকের মাধ্যমে এই অপকর্মটি করেছে।’’
জেলা বিজেপি সভাপতি সুনীল রুদ্র মণ্ডল অবশ্য এই গরমিলের দায় তৃণমূলের উপরেই চাপিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্য সরকারের কর্মীরাই ভোটার তালিকায় নাম সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজনের কাজ করেন। তৃণমূলের সব স্তরের জনপ্রতিনিধিরা রাজ্য জুড়ে সেই সব সরকারি কর্মীদের দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ তালিকা তৈরির চেষ্টা করেছেন। তাতেই ভুলবশত এক তৃণমূল নেতার নামও বাদ পড়ে গিয়েছে।’’
আরও পড়ুন:
রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারের জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরেও ‘গরমিলে’র অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে তৃণমূল। অভিযোগের ভরকেন্দ্র আবার সুকান্তর নিজের শহর বালুরঘাটই। বালুরঘাট পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর নীতা নন্দীর দাবি, বালুরঘাট পুরসভার চার নম্বর ওয়ার্ডের দুই বাসিন্দা মহামায়া সরকার এবং মহামায়া মুস্তাফি সরকারের সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের নম্বর একই। এঁদের সঙ্গে আবার গুজরাটের বাসিন্দা সুনীতা থাইয়ার পরিচয়পত্রের নম্বরও মিলে যাচ্ছে বলে তাঁর দাবি। ওই একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা শম্পা চক্রবর্তীর পরিচয়পত্রের নম্বরের সঙ্গে গুজরাতের বাসিন্দা কেটি দেবীর, গৌরী সরকারের সঙ্গে গুজরাতের বাসিন্দা আমিরভাই খোজার এবং পাপিয়া সরকারের সঙ্গে মহেশজি ঠাকুরের নম্বরও মিলে গিয়েছে বলে তৃণমূল কাউন্সিলর নীতার দাবি।
বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত এই ঘটনায় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন রাজ্যের শাসক দলকেই। সুকান্তের কথায়, ‘‘রাজ্যে রাজ্যে ভোটার তালিকা তৈরি বা পরিচয়পত্র তৈরির কাজ তো রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতর থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। আর মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক কে হবেন, সেটা মুখ্যমন্ত্রী স্থির করেন। মুখ্যমন্ত্রীর পাঠানো তিনটি নামের মধ্যে থেকে যে কোনও একজনকে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক করা হয়। অর্থাৎ এই কাণ্ড তো মুখ্যমন্ত্রীর নিজের পছন্দের আধিকারিকের তত্ত্বাবধানেই ঘটেছে।’’
তৃণমূল অবশ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার সুর আরও চড়িয়েছে। দলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন সোমবার নির্বাচন কমিশনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। বাংলার ভোটারদের এপিক (সচিত্র পরিচয়পত্র) নম্বরের সঙ্গে গুজরাত বা হরিয়ানার ভোটারদের এপিক নম্বর মিলে যাওয়ার ঘটনায় কমিশনকে ভুল স্বীকার করতে হবে বলে ডেরেক দাবি তুলেছিলেন। ভুল স্বীকার করার জন্য ২৪ ঘণ্টার সময়সীমাও তিনি বেঁধে দিয়েছিলেন। সেই সময়সীমা পেরতেই মঙ্গলবার ফের কমিশনকে আক্রমণ করেছে তৃণমূল। রাজ্যসভা সাংসদ সাগরিকা ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা কমিশনকে কালকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়ে বলেছিলাম, এপিক নম্বরের ক্ষেত্রে যে বিরাট অনিয়ম হয়েছে, তা মেনে নিন। না হলে আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে আরও একটা নথি প্রকাশ করব।’’ ‘নথি’ হিসেবে কমিশনের হ্যান্ডবুকের কথা সাগরিকা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘‘কমিশনের নিজের হ্যান্ডবুকে লেখা আছে, নকল (ডুপ্লিকেট) এপিক গ্রাহ্য করা হবে না। যদি কেউ অন্য কারও এপিকের নম্বর ব্যবহার করে নকল এপিক তৈরি করে ভোট দিতে যান, তা হলে তাঁকে ভোট দানে বাধা দেওয়া হতে পারে। সুতরাং কোনও সংশয় নেই যে, একজনের এপিক নম্বরের সঙ্গে অন্যের এপিক নম্বর মিলে যাওয়া একটা বিরাট কেলেঙ্কারি।’’