সাইকেলে প্রচার তৃণমূলের। বুধবার শান্তিপুরে। নিজস্ব চিত্র।
জাতীয় সড়কের ধারে দোতলা বাগান-বাড়ির মতো অফিস। বিশাল শামিয়ানায় ঢাকা ভিতরের মাঠ জুড়ে পোস্টার-ব্যানার। জটলায় ছড়িয়ে তিন প্রজন্মের ব্যস্ততা। গমগম করছে রাস্তা থেকে শুরু করে সেই অফিস-বাড়ির প্রতিটি কোনা। কী নেই সেখানে!
তবে এ সবের মধ্যেও অভাব একটা আছে। রাজ্যে বিপুল জয়ের পরেও শান্তিপুরের তৃণমূলে গভীর অপ্রাপ্তি। নিজেই সে কথা তুললেন তৃণমূলের শহর কমিটির সভাপতি বৃন্দাবন প্রামাণিক। বললেন, ‘‘একটা বার শাসক হওয়ার স্বাদ পেলাম না আমরা! দেখি না, অন্তত একটা বার, কেমন লাগে শাসক হলে।’’
২১৩টি আসনে জিতে ক্ষমতায় এলেও শান্তিপুরে গত মে মাসের নির্বাচনে বিজেপির কাছে হেরে গিয়েছে তৃণমূল। রানাঘাটের সাংসদ বিজেপির জগন্নাথ সরকারের কাছে হেরে গিয়েছেন তৃণমূলের সদ্যপ্রয়াত অজয় দে। তবে জগন্নাথ সাংসদ পদ রেখে বিধায়ক পদ ছেড়ে দেওয়ায় মাস পাঁচেকের মাথায় এই আসনের উপনির্বাচনে সেই অপ্রাপ্তি দূর করার সুযোগ পেয়েছে তারা।
শান্তিপুরে এ বার তাই ‘ডাবল ইঞ্জিন’ স্লোগানেও আপত্তি নেই তৃণমূল নেতাদের। দলের শহর কমিটির সদ্যপ্রাক্তন সভাপতি অরবিন্দ মৈত্রের কথায়, ‘‘বিরোধীরা জিতলে মানুষের কাজকর্ম, সুবিধা- অসুবিধা নিয়ে টালবাহানা করবে। সরকারের পরিকল্পনা ঠিক মতো রূপায়ণ করবে না। তাতে শান্তিপুরের মানুষেরই ক্ষতি।’’ এ বারের সুযোগ কাজে লাগাতে প্রস্তুতি নিশ্ছিদ্র করতে চেয়েছে তৃণমূল। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এড়াতে দলের টানাপড়েনে না থাকা তরুণ ব্রজকিশোর গোস্বামীকে প্রার্থী করা হয়েছে। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে আসা শান্তিপুরের গোষ্ঠীপতিদেরও এ বার অন্তত এক জায়গায় দেখা যাচ্ছে। জেলায় দলের প্রায় সব জনপ্রতিনিধিকে নিয়ে গোটা কেন্দ্রে চরকি পাক খাচ্ছেন সাংসদ মহুয়া মৈত্র। রাজ্যের নেতা, মন্ত্রীরা তো বটেই বিজেপির কাছে হারা আসনটি নিয়ে দলের প্রত্যাশা বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
এই প্রস্তুতিই কি তৃণমূলকে শাসকের স্বাদ দিতে পারবে? সংশয়ের কারণ বিরোধী ভোট এক জায়গায় চলে যাওয়ায় ৪২% ভোট পেয়েও দু’বার হারতে হয়েছে তাদের। ২০১৬ সালে সেই অঙ্কে ৫১ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জিতেছিল বাম-কংগ্রেস। আবার ২০১৯-এ লোকসভা, ২০২১ -এ বিধানসভায় জয় পেয়েছে বিজেপি। দু’টি ভোটেই বিজেপি পেয়েছে যথাক্রমে ৫৩ ও ৪৯% ভোট। বাম-কংগ্রেস জোটের বিধায়ক অরিন্দম ভট্টাচার্য প্রথমে তৃণমূলে ও পরে বিজেপিতে চলে যাওয়ায় ভোট এবং সংগঠনে ধাক্কা খেয়েছে জোট ও তৃণমূল দুই শিবিরই। সেই সঙ্গে সীমান্ত জেলার নানা অঙ্ক যোগ হওয়ায় ৪-৫ শতাংশ থেকে বিজেপির ভোট পৌঁছে গিয়েছে ৫০ শতাংশে। ফলে এ বার সব প্রস্তুতি সেরেও ২৪ ওয়ার্ডের পুরসভা এবং সমসংখ্যক ভোটারের ৬টি পঞ্চায়েত এলাকার শান্তিপুরে বিরোধী ভোটে ভাগাভাগির দিকে চোখ রাখতে হচ্ছে তৃণমূলকে।
ভোট ভাগের সম্ভাবনা নেই, তা একেবারেই নয়। লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে জিতেও শান্তিপুরের ভোট ধরে রাখার অবস্থায় নেই বিজেপি। দলের সাংসদকে বিধানসভায় প্রার্থী করে জিতলেও তাঁর পদত্যাগ নিয়ে প্রচারেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে বিজেপি নেতাদের। শান্তিপুরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতাও বিজেপি নেতাদের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে। তাই গত মে মাসে যে আসনে ১৫ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছেন, সেই আসন নিয়েও চিন্তা আছে জেলা বা রাজ্য স্তরের নেতাদের। নদিয়া জেলা সভাপতি অশোক চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘বিজেপির ভোট কাটতে তৃণমূল সিপিএমের দেওয়াল লিখে দিচ্ছি। বামেরা তৃণমূলের পক্ষে প্রচার করছে। তবে তাতে বিজেপির ভোট আরও বাড়বে।’’ হার-জিত তো আছেই, শান্তিপুরের ফল যে দলকে তার থেকেও বড় চিন্তায় রেখেছে, তা স্পষ্ট দলের আর এক নেতার কথায়, ‘‘উপনির্বাচনে শাসকের (তৃণমূল) জয় অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু রাজ্যে প্রধান বিরোধী হিসেবে বিজেপির গুরুত্ব রক্ষা করাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’’ যদিও প্রচারের সাজসাজ রব দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরের হাল কেমন।
তবে শান্তিপুরের উপনির্বাচনে তৃণমূল-বিরোধী ভোট ভাগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে প্রচারে সিপিএম মাথা তুলে দাঁড়ানোয়। বাজার, বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সিপিএমের কথা বললে তাদের প্রার্থীর নামই করছেন সাধারণ মানুষ। শান্তিপুর পুরসভার ডাকসাইটে বিরোধী দলনেতা সৌমেন মাহাতকে প্রার্থী করে প্রচারপর্ব থেকেই একটু সুবিধা পেয়েছে তারা। পোস্টার, ব্যানার আর দীর্ঘদিন দৈত্যাকার কাটআউট দেখে মনে হতেই পারে তিনিও চ্যালেঞ্জার। তৃণমূল অফিস থেকে অল্প দূরে সিপিএমের বিশাল অফিস বাড়ির চেহারাও অন্য রকম। দেওয়ালে লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড তৈরির পরামর্শ দিয়ে নোটিস ঝুলছে অফিসের দেওয়ালে। সে কথা তুলতে শান্তিপুরের বামফ্রন্টের আহ্বায়ক তথা সিপিএম নেতা অনুপ ঘোষ হেসেই বললেন, ‘‘আমরা তো সরকারি এই সব প্রকল্পের বিরোধী নই। তবে এই যে কাটমানি আর দুর্নীতি চালিয়ে দুটো দল চলছে তাদের বিরুদ্ধে।’’ এই আসনে জিততে পারলে বিধানসভায় শূন্য সিপিএমকে শান্তি দিতে পারবে শান্তিপুর। এই মুহূর্তে সেই কল্পনা সহজ নয়। সিপিএম নেতা সুমিত বিশ্বাসের দাবি, ‘‘পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। আমাদের ভোট ফিরছেই। কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের জোটের রাজনীতি ও তার পরিণতির কারণে এখানে যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল তা আমরা সামলে নিয়েছি।’’ কংগ্রেস প্রার্থী রাজু পালের পোস্টার, ব্যানার আছে। কিন্তু দল হিসেবে লড়াইয়ের এই বৃত্তে কংগ্রেস নেই।
শহরের প্রাণকেন্দ্র নেতাজি সুভাষ রোড বা বাগআঁচড়ার গ্রামীণ হাওয়ায় সিপিএমের এই উপস্থিতি আছে। তবে তা কত দূর বয়, তার উপরে অনেকটাই নির্ভর করছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল ও বিজেপির ভাগ্য। এই সম্ভাবনা মানছে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাতে অবশ্য নিজেদের বিপদ দেখছেন না তারা। প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটারের এই কেন্দ্র নিয়ে তৃণমূলের হিসেব, ‘‘এই কাটাকাটিতে বিজেপি আর সিপিএম মিলিত ভাবে ৬০-৭০ হাজারের বেশি ভোট পাবে না। আমরা ১ লাখ ভোটে জিতব।’’ আর বিজেপি বলছে, ‘‘বামেদের ভোট তারা ফিরে পাবে বলে মনে হচ্ছে ঠিকই, তবে যতটা প্রচার ততটা নয়। বাংলাদেশের ঘটনার পরে শান্তিপুরের উদ্বাস্তু মানুষ সে ভুল করবেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy