Advertisement
০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
Arabul Islam & TMC

কোর্টের নির্দেশে পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে ঢুকতে পারবেন আরাবুল, কিন্তু কাজ করতে পারবেন কি

গত সোমবার ভাঙড়–২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আরাবুলের অনুগামীরা পুষ্পবৃষ্টি মাথায় নিয়ে, গলায় মালা পরে পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে গেলেও বসার জায়গা পাননি। পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে ফিরলেও আরাবুলের এখন চেয়ার, ঘর কিছুই নেই।

TMC is not on the side of Arabul Islam, despite getting permission to join the post of Panchayat Samiti president by the orders of the court

আরাবুল ইসলাম। —ফাইল ছবি।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:০১
Share: Save:

গত ২৯ নভেম্বর কলকাতা হাই কোর্ট থেকে ভাঙড় দুই পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে গিয়ে সভাপতি হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার অনুমতি পান আরাবুল ইসলাম। কিন্তু তাঁকে যে কোনও ক্ষেত্রেই তৃণমূল নেতৃত্ব সহযোগিতা করবেন না, তা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপে। বর্তমানে ভাঙড় বিধানসভা তৃণমূলের দেখভাল করছেন ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক তথা আরাবুলের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী শওকত মোল্লা। তৃণমূল সূত্রে খবর, দলীয় অনুমোদন নিয়ে শওকত আরাবুলের সঙ্গে সহযোগিতা না করা নির্দেশ দিয়েছেন। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হিসাবে কাজে যোগ দিতে বিডিও অফিসে যেতে পারবেন আরাবুল। গত সোমবার ভাঙড়–২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আরাবুলের অনুগামীরা পুষ্পবৃষ্টি মাথায় নিয়ে, গলায় মালা পরে পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে গেলেও বসার জায়গা পাননি। পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে ফিরলেও আরাবুলের এখন চেয়ার, ঘর কিছুই নেই। যদিও খাতায়কলমে তিনি এখনও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। আরাবুল যখন জেলে, সেই সময়ে পঞ্চায়েত সমিতির সহ–সভাপতি সোনালী বাছাড়কে কার্যনির্বাহী সভাপতি করে সমিতির কাজকর্মের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাই দলের কাছে সোনালী এখন ভাঙড় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সভাপতি হিসাবে সোনালীকেই কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সোনালী বসছেন সহ–সভাপতির ঘরেই। আর সভাপতির ঘরে ঢোকার মুখে আরাবুলের নেমপ্লেট খুলে নিয়ে সেখানে বসেছে পঞ্চায়েত সমিতির বন ও ভূমি বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ খাইরুল ইসলামের নেমপ্লেট। ভাঙড়ের রাজনীতিতে যিনি আবার আরাবুলের ঘোর বিরোধী বলে পরিচিত। ক্যানিং–পূর্বের তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লার অনুগামী হিসেবে পরিচিত খাইরুলই এখন ওই ঘরে বসেন। তাই এখন আরাবুলের বসার ঘর নেই। আরাবুলের ঘর পেতে কী সমস্যা? তা জানতে ভাঙড়–২ নম্বর ব্লকের বিডিও পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন আরাবুলের আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি। তাতেও সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। বৃহস্পতিবার পঞ্চায়েত সমিতিতে যাচ্ছিলেন আরাবুল। তখনও বিডিও অফিস চত্বরে গেটের কাছে পুলিশ রুটিনমাফিক গাড়ি তল্লাশি চালায়। গাড়ির পিছন থেকে কোদালের বাঁট, পাইপ উদ্ধার করে পুলিশ। এই সব নিয়ে আরাবুল কোথায় যাচ্ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন। আরাবুলকে নিয়ে দলের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন তৃণমূল বিধায়ক শওকত। তিনি বলেছেন, ‘‘পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূলের যে নির্বাচিত সদস্যরা রয়েছেন, তাঁদের সকলকেই আরাবুল প্রসঙ্গে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলে দেওয়া হয়েছে, কেউ যেন আরাবুল ইসলামের সঙ্গে পঞ্চায়েত সমিতির কাজে সহযোগিতা না করেন।’’ প্রসঙ্গত, ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির অধীনে যে ২৬ জন সদস্য রয়েছেন, তাঁদের ২৪ জনই দলীয় নির্দেশ মেনে চলবেন বলে শওকত দাবি করেছেন।

চলতি বছর ৮ ফেব্রুয়ারি তোলাবাজির অভিযোগে আরাবুলকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। আর ৪ জুন লোকসভা ভোট পর্ব শেষ হতেই ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকে আরাবুলকে সরিয়ে দেয় তৃণমূল। ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর আচমকা ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক ডাকেন ক্যানিং পূর্ব তৃণমূল বিধায়ক শওকত। সেই বৈঠকেই দলীয় সিদ্ধান্তের কথা স্থানীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দেওয়া হয়। বৈঠকে শওকত জানিয়ে দেন, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দীর্ঘ দিন না থাকায় কাজকর্মে অসুবিধা হচ্ছে। তাই তাঁর বদলে পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি সোনালী বাছাড়কে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।

২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়ী হয়ে ভাঙড় দুই ব্লক পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হন আরাবুল। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কারাবন্দি থাকায় জুন মাসে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। বর্তমানে আরাবুল আর দলের কোনও পদে নেই। কারণ, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই ভাঙড় বিধানসভার ‘আহ্বায়ক’ পদ দেওয়া হয়েছিল আরাবুলকে। সেই পদ থেকে এ বছর এপ্রিল মাসে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরে আরাবুল দলের আর কোনও সাংগঠনিক বা প্রশাসনিক দায়িত্বে নেই। ভাঙড়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সিপিএম থেকে আগত নেতা শওকতের দাপটে তৃণমূলের আদি নেতা ‘আরাবুল জমানা’ কি শেষ?

আরাবুলকে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তৃণমূলের একটি সূত্র জানিয়েছিল, কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে ‘অসহযোগিতার’ অভিযোগ তুলে স্ত্রীর মাধ্যমে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন আরাবুল। তাঁর স্ত্রী জাহানারা বিবি অভিযোগ করেছিলেন, স্বামীর বিরুদ্ধে মোট ১৩টি মামলা রয়েছে বলে তাঁরা অবগত। এর বাইরে তাঁর বিরুদ্ধে আর কোনও মামলা রয়েছে কি না, তা জানতে চাইলেও কলকাতা পুলিশ তাঁদের সেই তথ্য দিচ্ছে না। শাসকদলের নেতার স্ত্রীর এমন অভিযোগে ‘অস্বস্তিতে’ পড়েছিল কলকাতা পুলিশ। বিচারপতি জয় সেনগুপ্তের এজলাসে ওই মামলার শুনানিতে আরাবুলের আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি দাবি করেছিলেন, পুলিশি হেফাজতে রেখেই একের পর এক মামলায় যুক্ত করা হচ্ছে আরাবুলকে। তার পরেই ভাঙড়ের আহ্বায়ক পদ থেকে আরাবুলকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৃণমূল।

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভাঙড় ছিল বসিরহাট লোকসভার অন্তর্গত। সেই ভোটে তৃণমূল প্রার্থী সুজিত বসু ভাঙড় থেকে ৫২ হাজারের বেশি ভোটে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙড় আসনে তৃণমূলের টিকিটে জিতেছিলেন আরাবুল। সেই ভোটে বামফ্রন্টের ২৩৫ আসন জয়ের মধ্যেও ভাঙড়ে আরাবুলের জয় তৃণমূলের কাছে ছিল বড় প্রাপ্তি। সেই থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে আলোচনায় উঠে আসেন আরাবুল। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম নেতৃত্বের সঙ্গে আরাবুলের গোষ্ঠীর সংঘর্ষের খবর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। তৎকালীন বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার ভূমি ও ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার গোষ্ঠীর সঙ্গে আরাবুলের গোষ্ঠীর বিবাদ ছিল তখন ভাঙড়ের রাজনীতির নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বর্তমানে ক্যানিং পূর্বের তৃণমূল বিধায়ক তথা ভাঙড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা শওকত তখন আরাবুলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রেজ্জাকের পাশেই ছিলেন। তখন থেকেই ভাঙড়ে ‘আরাবুল জমানা’র সূত্রপাত। অধুনা জেলবন্দি নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় আরাবুলকে ‘ভাঙড়ের তাজা নেতা’ বলে আখ্যা দেওয়ার পরে দলের অন্দরে ভাঙড়ের বিধায়কের ‘প্রতাপ’ আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি নিজের দলের মধ্যেও অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন আরাবুল। সেই ঘটনার জেরে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে রাজ্য জুড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়জয়কার হলেও ভাঙড়ে পরাজিত হন আরাবুল। অধুনাপ্রয়াত তৃণমূল নেতা নন্নু হোসেন ভাঙড়ে নির্দল প্রার্থী হিসাবে লড়াই করায় ভোট কাটাকাটিতে হেরে যান আরাবুল। জয়ী হন সিপিএমের বাদল জমাদার।

যদিও ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে জয়ী হলে ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হন আরাবুল। এর পরে ২০১৫ সালে দলবিরোধী কার্যকলাপের জেরে ছ’বছরের জন্য তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড করা হয় ‘তাজা নেতা’কে। যদিও মাস আটেকের মধ্যেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের তৎকালীন সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তাঁকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জোড়া ধাক্কা খান আরাবুল। যে রেজ্জাকের সঙ্গে লড়াই করে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান, ভাঙড় বিধানসভায় তাঁকেই প্রার্থী করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ বুজে তা মেনে নেওয়া ছাড়া আরাবুলের উপায় ছিল না। একই সঙ্গে দলের অন্দরে তাঁর ‘প্রবল প্রতিপক্ষ’ শওকতকে ক্যানিং-পূর্ব আসন থেকে টিকিট দেয় তৃণমূল। রেজ্জাক-শওকত দু’জনেই জেতেন। আর ভাঙড়ের রাজনীতিতে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকেন আরাবুল। ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে জিতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হলেও তাঁর আর আগের মতো ‘দাপট’ ছিল না। কারণ, তত দিনে ভাঙড় তৃণমূলের সাংগঠনিক দায়িত্ব চলে গিয়েছে শওকতের হাতে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এড়াতে স্থানীয় নেতাদের বাদ দিয়ে চিকিৎসক রেজাউল করিমকে ভাঙড়ে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। কিন্তু সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকি সেখানে জিতে যান। বিজেপি ছাড়া সারা রাজ্যে ওই একটি আসনেই জিতেছিল বিরোধী পক্ষ। ওই হারে আরাবুলের বিরুদ্ধেই ‘অন্তর্ঘাতের’ অভিযোগ তুলেছিল তৃণমূলের একাংশ। পরে পঞ্চায়েত ভোটে তাঁকে ‘আহ্বায়ক’ পদ দেওয়া হলেও চাবিকাঠি ছিল শওকতের হাতেই। এখন সেই পদ-সহ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকেও নেই আরাবুল । যা জেনে ভাঙড়ের আরাবুল অনুগামীরা বলছেন, ‘‘আরাবুলদার পাশে দাঁড়াতে পারেন, এমন কোনও নেতা বোধ হয় আর তৃণমূলে নেই। দাদা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ভাঙড়ে ফিরছেন ঠিকই, কিন্তু তৃণমূলে রাজনীতির করার পরিসর পাবেন কি না, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। দাদার পাশে আছেন কেবল তাঁর ছেলে হাকিমুল।’’ আরাবুলের পুত্র বর্তমানে ভাঙড়-২ ব্লক থেকে তৃণমূলের জেলা পরিষদ সদস্য।

অন্য বিষয়গুলি:

Arabul Islam Tmc Leader Bhangar panchayat samiti tmc panchayat samity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy