শোভন চট্টোপাধ্যায়, সোহম চক্রবর্তী। ফাইল চিত্র
তাঁর দলবদলের বছর ঘুরতে চলল। দলবদল করলেও রাজনীতিতে সক্রিয় হননি তিনি। হননি বলেই সম্ভবত দলবদলের পরেও তাঁকে নিয়ে টানাপড়েন অব্যাহত থেকেছে। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা বেহালা পূর্বের বিধায়ক শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ফিরে পেতে বা সঙ্গে রাখতে একনাগাড়ে সক্রিয় থেকেছে তৃণমূল বা বিজেপি। যদিও গেরুয়া হোক বা সবুজ, কোনও ময়দানেই এখনও খেলা শুরু করেননি শোভন। কিন্তু শোভনকে বাদ দিয়ে চলার সিদ্ধান্ত সম্ভবত চূড়ান্ত করেই ফেলল রাজ্যের শাসক দল। বেহালা পূর্বে সেলিব্রিটি প্রার্থী দেওয়ার ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। বেহালার ‘ভূমিপুত্র’ তথা অভিনেতা সোহম চক্রবর্তীর তৎপরতাও সম্প্রতি বেড়ে গিয়েছে এলাকায়।
১৯৭২-এর নির্বাচন বাদ দিলে স্বাধীনতার পর থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কখনও বেহালা পূর্ব আসন বামেদের হাতছাড়া হয়নি। ২০০১ সালে প্রথম বার কংগ্রেস সমর্থিত তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে বেহালা পূর্ব থেকে জেতেন পরশ দত্ত। ২০০৬ সালে আবার সিপিএম পুনরুদ্ধার করে নেয় সে আসন। তার পরে ২০১১ থেকে টানা এ পর্যন্ত ওই কেন্দ্রের বিধায়ক শোভন চট্টোপাধ্যায়। দু’বারই শোভন জিতেছেন তৃণমূলের টিকিটে। তবে ২০১৯-এর অগস্ট থেকে শোভন আর তৃণমূলে নেই। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।
শোভনের দলবদলের সঙ্গে সঙ্গেই বেহালা পূর্বে বিকল্প মুখ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা তৃণমূল করেনি। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত জনভিত্তিকে ওই এলাকায় দুর্বল করার চেষ্টা হয়েছে। শোভনের ডান হাত-বাঁ হাত হিসেবে যাঁরা পরিচিত ছিলেন বেহালায়, তাঁদের প্রায় প্রত্যেককেই শোভনের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে তৃণমূল নেতৃত্ব সফল। কিন্তু শোভনকে ফেরানোর চেষ্টাও নিরন্তর চলছিল। তৃণমূল মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তো গত এক বছরে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন শোভন শিবিরের সঙ্গে। সেতু হিসেবে কাজ করেছেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। শোভনের বাড়ি গিয়েও পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বৈঠক করে আসতে দেখা গিয়েছে। তাতেই শেষ নয়, বিজেপিতে চলে যাওয়া শোভনের সঙ্গে গত এক বছরে বেশ কয়েক বার যোগাযোগ করেছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ভাইফোঁটায় মমতার বাড়িতে শোভন-বৈশাখীর হাজির হওয়া এবং বৈশাখীকে নবান্নে ডেকে পাঠিয়ে মমতার একান্ত বৈঠক সে সবের মধ্যে অন্যতম।
আরও পড়ুন: মল্লিক পরিবারে করোনার হানা, আক্রান্ত রঞ্জিত-কোয়েলরা
এত কিছুর পরেও তৃণমূলে শোভনের প্রত্যাবর্তন ঘটেনি। প্রত্যাবর্তন যে অনিশ্চিত, তা ধরে নিয়ে স্থানীয় নেতাদের অনেককেই শোভনের এলাকায় নানা ভাবে সক্রিয় করে তোলা হয়েছে। তাঁদের কেউ দাপুটে কাউন্সিলর, কেউ মেয়র পারিষদ, কেউ বরো চেয়ারম্যান। প্রত্যেকেই বেহালা বা পার্শ্ববর্তী এলাকার রাজনীতিতে দীর্ঘ দিন রয়েছেন। তবু বেহালা পূর্ব নিয়ে খুব নিশ্চিন্ত বোধ হয় হতে পারছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব। তাই বেহালা পূর্বে যাঁর নাম ভাবা হচ্ছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর, তিনি তৃণমূলে থাকলেও আসলে দলের রাজনৈতিক মুখ নন। তিনি দলের অন্যতম সেলিব্রিটি মুখ— সোহম চক্রবর্তী।
আরও পড়ুন: ‘আই হোপ, বিকাশ পৌঁহুছে না’, বলেছিলেন উজ্জয়িনীর পুলিশ অফিসার, প্রশ্ন এনকাউন্টার নিয়ে
সোহম এর আগেও তৃণমূলের টিকিটে ভোটে লড়েছেন। বাঁকুড়ার বড়জোড়া বিধানসভা আসনে ২০১৬ সালে হেরেও এসেছেন। তবে বেহালার ছেলে সোহম নিজের বেহালার রাজনীতিতে খুব সক্রিয় ছিলেন না কোনও কালেই। সম্প্রতি চোখে পড়ার মতো করে সে সক্রিয়তা বেড়েছে। বেহালার পৈতৃক বাসস্থান ছেড়ে সোহম মাঝে চলে গিয়েছিলেন জোকার কাছে অভিজাত আবাসনে। কিন্তু সম্প্রতি আবার তিনি রায়বাহাদুর রোড এলাকাতেই ফিরেছেন। শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিল এলাকার যে সব নাম, সে রকম বেশ কয়েক জন এখন সোহম ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। এলাকার রাজনীতিতে নিজের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়াচ্ছেন টলিউডের অভিনেতা।
স্থানীয় সূত্রের খবর, সোহম নিজের মর্জি মতোই এ সব শুরু করে দিয়েছেন, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। তৃণমূল নেতৃত্বের খুব উচ্চস্তর থেকেই সোহমের কাছে বার্তা গিয়েছে বলে খবর। সেই কারণেই ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বেহালা পূর্ব আসনে লড়ার জন্য সোহম প্রস্তুত হচ্ছেন এবং এলাকায় নিজের ভিত বাড়াচ্ছেন বলে স্থানীয় তৃণমূলের একাংশের দাবি। তৃণমূল নেতৃত্বের কোন স্তর থেকে সোহমের কাছে বার্তা গিয়েছে? মন্তব্য করতে চান না কেউ। তবে সোহম যে এখন দলের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড তথা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুনজরে রয়েছেন, সে বিষয়ে বেহালা এলাকার প্রায় সব তৃণমূল নেতা-কর্মীই একমত হচ্ছেন।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আসন অর্থাৎ বেহালা পশ্চিম এলাকায় সক্রিয় এক তৃণমূল নেত্রীর কথায়, ‘‘বেহালা পূর্বের জন্য বেশ কয়েকটা নাম তো শুনতে পাচ্ছি। সোহম চক্রবর্তীর নাম তার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে। তবে কেউ কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষের নাম বলছেন, কেউ মেয়র পারিষদ তারক সিংহের নাম বলছেন। কে শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হবেন, জানি না।’’ অর্থাৎ এতগুলো নাম যখন আলোচনায় উঠে এসেছে, তখন শোভনের বিষয়ে তৃণমূল যে আর ভাবছে না, তা স্পষ্টই। স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে যাঁরা শোভনের অনুগামী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁরাও আর শোভনের প্রত্যাবর্তনের আশা রাখছেন না বলেই খবর। বরং পোড় খাওয়া রাজনীতিক ‘কাননদা’র বদলে এ বার রাজনীতিতে ঈষৎ শিক্ষানবিশ তথা সেলিব্রিটি প্রার্থী সোহমের জন্য ময়দানে নামতে হবে ভেবে নিয়েই প্রস্তুত হচ্ছেন।
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এ বিষয়ে মুখ খুলতে একেবারে নারাজ। সম্প্রতি এক ভিডিয়ো বৈঠকে দলীয় বিধায়কদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন— কারা আবার ভোটে লড়তে চাও হাত তোলো। বলাই বাহুল্য হাত না তুলে বসে থাকতে কেউই চাননি। তবে সে বৈঠকে বেহালা পূর্বের বিধায়ক শোভন চট্টোপাধ্যায় তো ছিলেন না। অতএব বেহালা পূর্বের জন্য কারও হাত তোলার প্রশ্নও আসেনি। আর সে কথাই মনে করিয়ে দিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা সাংসদ শুভাশিস চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘বেহালা পূর্ব আসন তো খালিই রয়েছে।’’ অর্থাৎ শোভনকে নিয়ে আর যে ভাবা হচ্ছে না, সে ইঙ্গিত স্পষ্ট ভাবেই দিচ্ছেন শুভাশিস। কিন্তু সোহম চক্রবর্তী প্রার্থী হচ্ছেন কি না, সে বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করছেন না। শুভাশিসের কথায়, ‘‘এ বিষয়ে কোনও আলোচনা তো এখনও হয়নি। আমার অন্তত জানা নেই।’’
তৃণমূল নেতৃত্ব মুখ না খুললেও, বেহালায় সোহম চক্রবর্তীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতা অনেকেরই চোখে পড়ছে। নেতৃত্বের কাছ থেকে বার্তা না পেলে সোহম এ ভাবে সক্রিয় হতেন না বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত। কিছুটা ইঙ্গিত মিলছে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়ের কথায়। কে প্রার্থী হচ্ছেন, সে বিষয়ে সরাসরি তিনি কিছু বলছেন না। তবে আরও কয়েকটা নামের মধ্যে সোহমের নামও যে শোনা যাচ্ছে, তা রত্না অস্বীকার করছেন না। শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতো পোড় খাওয়া এবং দীর্ঘ দিনের রাজনীতিকের বিকল্প হিসেবে সোহম চক্রবর্তী কি উপযুক্ত? রত্নার কথায়, ‘‘আমাদের দলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্থির করেন কে প্রার্থী হবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁকেই প্রার্থী করবেন, আমরা তাঁর হয়েই কাজ করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy