শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
পাঁচ বছরের ব্যবধানে লড়াইয়ের রাজা-মন্ত্রী-গজ-বোরেরা সব ওলটপালট। তৃণমূল জন্মের কয়েক বছর পর থেকে ২০২০ পর্যন্ত পূর্ব মেদিনীপুরে দলের মাথায় বরাবরই অধিকারী পরিবারের রাজত্ব। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট ছিল তৃণমূলে থাকা শুভেন্দু অধিকারীর লড়াই। এ বার তৃণমূলহীন শুভেন্দু কি নিজের জেলায় সম্মানজনক জমি ধরে রাখতে পারবেন? না কি শুভেন্দু এবং তাঁর অধিকারী পরিবারকে ছাড়াই আবার একই ছন্দে পূর্ব মেদিনীপুর দখল করবে তৃণমূল? মঙ্গলবারই এর উত্তর স্পষ্ট হয়ে যাবে। যদিও শনিবারের ভোটের পর বিজেপি তথা শুভেন্দুর পক্ষে বড় বাজি ধরছেন না জেলা রাজনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞজনেরা।
কারণ, ভোটের দিনে জেলার অধিকাংশ এলাকা জুড়েই দাপট দেখিয়েছে শাসকদল তৃণমূল। আবার ময়না, পটাশপুর বা খেজুরির মতো ব্লকে ভোটের পর সন্তুষ্ট দেখিয়েছে বিজেপিকে। কিন্তু শুধু এই কয়েকটি ব্লকের উপর দাঁড়িয়ে জেলা পরিষদ দখলের কথা ভাবা সম্ভব নয়। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোনও বিজেপি নেতা তেমন দাবি করছেনও না। ভগবানপুরের বিজেপি বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ মাইতি যেমন তাঁর জেলার ফলের সঙ্গে শুভেন্দুর সাফল্য-অসাফল্য মাপতেই রাজি নন। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘শুভেন্দুবাবু কী ভাবে সারা রাজ্যের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন, তা গোটা দেশ দেখেছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ভুমিপুত্র তিনি, তাই হয়তো তাঁর জেলা নিয়ে এত বেশি আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু শুভেন্দুবাবুর লড়াই শুধুমাত্র পূর্ব মেদিনীপুরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। যবে থেকে তিনি বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব নিয়েছেন, তবে থেকেই তিনি রাজ্যের সব প্রান্তে গিয়ে মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন, তাই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার জয় পরাজয় দিয়ে তাঁর নেতৃত্বের মূল্যায়ন করা উচিত হবে না।’’
তৃণমূল অবশ্য দাবি করছে, পূর্ব মেদিনীপুরে শুভেন্দুর অতীত সাফল্য পুরোটাই ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে। জেলার তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের কারামন্ত্রী অখিল গিরির কথায়, ‘‘পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কেন, বিরোধী দলনেতা নিজের বিধানসভার অধীনে থাকা জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতেই জিততে পারবেন না। জেলাতেও সার্বিক ভাবে বিজেপির ফল খারাপ হবে বলেই আমরা মনে করছি। আসলে দিদির আলোয় আলোকিত হয়েই উনি সব কিছু করেছিলেন। দিদির ছবি সরে যেতেই বিরোধী দলনেতার প্রকৃত মূল্য প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। যিনি নিজের বিধানসভা এলাকার পঞ্চায়েতও হয়তো জেতাতে পারবেন না।’’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘বিধানসভা ভোটে কারচুপি করে জেতার শাস্তিও নন্দীগ্রামের মানুষ এ বার তাঁকে দিয়ে দিয়েছে। ফল বেরোলেই দেখতে পাবেন।’’
তৃণমূলে থেকে চারটি পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে শুভেন্দুর। ২০০৩, ২০০৮, ২০১৩ এবং ২০১৮। প্রথমটি বাদে বাকি তিনটিতেই জয় পেয়েছিল তৃণমূল। বিরোধী দলে থাকাকালীন শাসকদল সিপিএমের থেকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদ ছিনিয়ে এনেছিলেন শুভেন্দু। ২০০৮ সালের বাম আমলের শেষ পঞ্চায়েত ভোটে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাশাপাশি এই জেলা পরিষদ দখল করেছিল তৃণমূল। সৌজন্যে নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন। সেই থেকে শুভেন্দুর জেলা বলেও পরিচিত হতে থাকে পূর্ব মেদিনীপুর। তখন জেলা তৃণমূলের সভাপতি ছিলেন শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী।
২০১৩ সালের পঞ্চায়েতে বামেরা জেলা পরিষদে মাত্র ৬টি আসনে জেতে। বাকি সব শুভেন্দুর তৃণমূল। ২০১৮ সালে ৬০টি জেলা পরিষদ আসনের সবক’টিই জিতে নেয় তৃণমূল। ৭টিতে জয় এসেছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তৃণমূল ৬২ শতাংশ, বামেরা ১৮ শতাংশ এবং বিজেপি ১৯ শতাংশের মতো ভোট পায়।
২০২৩ সালে জেলা পরিষদের আসন সংখ্যা বেড়েছে পূর্ব মেদিনীপুরে। এ বার জেলা পরিষদে ৭০টি আসন। কেমন ফল করবে শুভেন্দুর বিজেপি? দেড় দশক পর বিরোধী নেতা হিসেবে তাঁকে পঞ্চায়েত ভোটের মুখোমুখি হতে হয়েছে নিজের জেলায়। একটা সুবিধা শুভেন্দুর রয়েছে। দীর্ঘ দিন তৃণমূলের সঙ্গে থাকার কারণেই এর সাংগঠনিক ক্রিয়াকৌশলের সঙ্গে তিনি পরিচিত। বিরোধী নেতা হিসেবে পাল্টা কৌশল তৈরিতে এটা সুবিধাজনক বটেই। কিন্তু বিজেপি নেতাদের যুক্তি, শুভেন্দু পূর্ব মেদিনীপুরের লোক হতে পারেন, দীর্ঘ দিন এই জেলায় সংগঠনও করেছেন তিনি, এই জেলা থেকেই তিনি বিধায়ক হয়ে বিরোধী দলনেতা, কিন্তু এই জেলায় বিজেপির কোনও সাংগঠনিক গুরুদায়িত্বেই তিনি নেই। রাজ্যনেতা হিসেবেই এখন তিনি এই জেলায় সভা-সমাবেশ করেন। এই তথ্য ঠিক হলেও, এটাও ঠিক যে, বছরের পর বছর ধরে যে জেলায় তিনি সংগঠন করেছেন, যে জেলা থেকে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে হারিয়েছেন, সেই জেলার ফলের সঙ্গে তাঁর নাম বিচ্ছিন্ন করার মতো সময় এখনও আসেনি।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে শুভেন্দুর আনুষ্ঠানিক দলবদল। ওই বছর ১৯ ডিসেম্বর তৃণমূল ছেড়ে অমিত শাহের হাত ধরে বিজেপিতে যোগদান করেন শুভেন্দু। তাঁর যোগদানের প্রভাবেই ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে পূর্ব মেদিনীপুরের ১৬টি বিধানসভা আসনের মধ্যে বিজেপি ৭টিতে জেতে। তৃণমূল ৯টিতে। বেশ কয়েকটি আসনে সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। তাই রাজনৈতিক মহলের ধারণা ছিল, এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে নিজের জেলার মাটি ধরে রাখতে জেলা পরিষদ দখলের চেষ্টা করবেন বিরোধী দলনেতা।
সেটা কি সম্ভব? বিজেপির জেলা নেতাদের একাংশ মনে করছেন, বেশ কিছু জেলা পরিষদ আসন, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতে জিতবেন তাঁরা। কিন্তু জেলা পরিষদে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের কথা বা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেওয়ার কথাও হলফ করে বলতে পারছেন না কেউ। বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, যে সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে, তাতে মানুষের মতামতের বহিঃপ্রকাশই সম্ভব নয়। তাই পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কেন, গোটা রাজ্যেই বিরোধীদের ভাল ফল করা মুশকিল বলেই মত প্রকাশ করেছে রাজ্য বিজেপির একাংশ। তবে একই সঙ্গে বিজেপি মনে করছে, সম্মানজনক বিরোধী হবেন তাঁরাই।
কী হবে শুভেন্দুর নন্দীগ্রামে? নন্দীগ্রাম-১ নিয়ে বিজেপির সে ভাবে কোনও প্রত্যাশা নেই। তবে নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর ‘ভালমন্দ’ নির্ভর করছে ২ নম্বর ব্লকের ফলাফলের উপর। গোটা জেলার ফলের পাশাপাশি, এই ব্লকের অধীনে থাকা জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের দিকে আলাদা ভাবে তাকিয়ে রয়েছে বিজেপি রাজ্য নেতৃত্বও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy