অভিষেকের নেতৃত্বে নয়া নেটওয়ার্ক। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
যুব সমাবেশের এক মাস আগে থেকে রাজ্য জুড়ে বিরাট যুব নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা শুরু করল তৃণমূল। তবে অরাজনৈতিক মোড়কে। দলের সঙ্গে সংযোগ লুকনোর চেষ্টা নেই, কিন্তু স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অরাজনৈতিক ছেলেমেয়েদের কাছে টানাই অগ্রাধিকার। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিডিয়ো বৈঠক থেকে অন্তত তেমন বার্তাই বেরিয়ে এল। মঙ্গলবার দলের যুবনেতাদের সঙ্গে ভিডিয়ো বৈঠক করে ‘বাংলার যুবশক্তি’ নামে এক নতুন কর্মসূচি তথা নেটওয়ার্ক গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন অভিষেক। শহিদ দিবসের ১০ দিন আগেই শেষ হবে সেই নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ। তবে রাজ্য জুড়ে গড়ে তোলা ১ লক্ষ ২৫ হাজার যুবার এই নতুন নেটওয়ার্ক শুধু ২১ জুলাইয়ের সাফল্যের লক্ষ্যে কাজ করবে না। প্রায় সমান্তরাল সংগঠনের আকারে নতুন জনভিত্তিও তৈরির চেষ্টা হবে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রশান্ত কিশোরের (পিকে) যৌথ পরিকল্পনা দেখে অন্তত তেমনই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
২১ জুলাইয়ের সমাবেশ এ বার ধর্মতলাতেই, নাকি ভার্চুয়াল সভা করতে হবে, নিশ্চিত নন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু ওই শহিদ স্মরণ সমাবেশ প্রতি বছর যে ভাবে চাঙ্গা করে তোলে তৃণমূলের আদি আবেগ, তা অন্য কোনও কর্মসূচির পক্ষেই সম্ভব নয়। সেই সভার আয়োজন যদি ডিজিটাল মাধ্যমে করতে হয় এ বার, তা হলেও যেন জমায়েতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি না থাকে— এমনটা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়েছেন তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘বাংলার যুবশক্তি’ নামে যে নতুন কর্মসূচি তিনি মঙ্গলবার ঘোষণা করেছেন সুব্রত বক্সী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়দের পাশে নিয়ে, সেই কর্মসূচিও কিন্তু শহিদ স্মরণের প্রস্তুতিকে অনেকটাই এগিয়ে রাখবে।
বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১১ জুন থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করছে ‘বাংলার যুবশক্তি’। নামে কর্মসূচি হলেও কার্যত কিন্তু প্রায় নতুন সংগঠন, যাকে ‘অরাজনৈতিক’ চরিত্র দেওয়ার চেষ্টাও হচ্ছে সচেতন ভাবে। মঙ্গলবার ভিডিয়ো কনফারেন্স অ্যাপের মাধ্যমে বৈঠক করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী, মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়রাও ছিলেন অভিষেকের সঙ্গে। রাজ্যের প্রায় সব প্রান্তের প্রতিনিধিদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বৈঠকে। মূলত যুব তৃণমূলের নেতারাই আমন্ত্রিত ছিলেন। ‘বাংলার যুবশক্তি’ কর্মসূচির রূপরেখা কেমন হবে, তা সে বৈঠকে বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়।
গোটা রাজ্যকে মোট ৫টি জোনে ভাগ করা হয়েছে এই কর্মসূচির জন্য। জোনের অধীনে থাকবে জেলা কমিটি। জেলা কমিটিগুলির অধীনে থাকবে ফিল্ড কমিটি। জোন, জেলা এবং ফিল্ড কমিটির দায়িত্ব দেওয়া থাকবে এক বা একাধিক কো-অর্ডিনেটরের হাতে। তাঁদের নির্দেশেই কাজ করবেন কমিটির অন্য সদস্যরা। জেলা কমিটিগুলোর এক এক জন সদস্যের উপরে দায়িত্ব থাকবে ২টি বা ৩টি ব্লক বা শহরের। একেবারে নীচের স্তরে থাকছেন ফিল্ড ইউনিট মেম্বাররা। প্রত্যেক ফিল্ড ইউনিট মেম্বারের উপরে দায়িত্ব থাকবে ১০টি করে পরিবারের।
আরও পড়ুন: যান-দুর্ভোগ কমাতে সরকারি কর্মীদের দু’ভাগে কাজের সময় বাঁধলেন মুখ্যমন্ত্রী
জোনাল কমিটিকে কত দিনের মধ্যে জেলা কমিটি গড়ে দিতে হবে, জেলা কমিটিগুলি কত দিনের মধ্যে ফিল্ড কমিটি গড়ে দেবে, ফিল্ড কমিটি কত দিনের মধ্যে ব্লক স্তরের সদস্য সংগ্রহ অভিযান সারবে— সবই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে মঙ্গলবারের ভিডিয়ো বৈঠকে। একেবারে নীচের স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর— সব পর্যায়ের সদস্য সংগ্রহ এবং কমিটি গঠনের বিশদ বিবরণ পৌঁছবে টিম পিকের কাছে। তৃণমূল যুব কংগ্রেসের নেতৃত্ব এবং টিম পিকের তরফ থেকে যৌথ ভাবে গোটা প্রক্রিয়ায় নজর রাখা হবে। ১১ জুলাইয়ের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ পুরোপুরি শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন অভিষেক। অর্থাৎ ১১ জুন থেকে ১১ জুলাইয়ের মধ্যেই ১ লক্ষ ২৫ হাজার যুবক-যুবতীকে এই নতুন কর্মসূচি তথা নেটওয়ার্কের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার কাজ সেরে ফেলা হবে।
কী কাজ করবে বাংলার যুবশক্তি? গোটা রাজ্যে সাধারণ মানুষের কাছে ‘জনপরিষেবা’ পৌঁছে দেবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ নানা নাগরিক পরিষেবা পেতে কার কী সমস্যা হচ্ছে, সে দিকে নজর রাখবেন বাংলার যুবশক্তির সদস্যরা। সমস্যার গুরুত্ব বুঝে নিয়ে দল, পঞ্চায়েত, পুরসভা বা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে সবের সমাধান করার চেষ্টা করবেন তাঁরা। অর্থাৎ রাজ্য জুড়ে ১ লক্ষ ২৫ হাজার যুবাকে তৈরি রাখা হচ্ছে, যাঁরা সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ রাখবেন এবং সে সব মেটানোর জন্য প্রশাসন ও নাগরিকের মধ্যে সেতুর মতো কাজ করবেন।
কারা যোগ দিতে পারবেন এই সংগঠন বা কর্মসূচিতে? তৃণমূল সূত্রের খবর, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী যুবক-যুবতীদেরই বেছে নেওয়া হবে। যাঁদের গায়ে কোনও রাজনৈতিক রং নেই, নিজের নিজের এলাকায় যাঁদের ভাবমূর্তি ভাল, তাঁদেরই এই কর্মসূচির সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার চেষ্টা হবে। তবে সব এলাকা এবং সব শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব যাতে থাকে ফিল্ড কমিটি বা ফিল্ড ইউনিটগুলিতে, সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: কোভিড হাসপাতালের বিরোধিতা করে সাগর দত্তে কর্মবিরতি ইন্টার্নদের
যে কোনও কর্মসূচির ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপনায় কর্পোরেট ছোঁয়া পছন্দ করেন যুব তৃণমূলের প্রধান তথা ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। নিখুঁত ব্যবস্থাপনা এবং ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহার খুব প্রিয় তৃণমূলের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ডের। টিম পিকে-ও ঠিক সে ভাবেই কাজ করতে পছন্দ করে। এই নতুন কর্মসূচি যে হেতু পুরোপুরিই অভিষেক এবং পিকের যুগলবন্দিতে যাত্রা শুরু করছে, সে হেতু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। বাংলার যুবশক্তির জন্য আলাদা ওয়েবসাইট খুলে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। যাঁরা যোগদান করবেন, ওই ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই তাঁদের নাম নথিভুক্ত করা হবে। প্রত্যেক এলাকার জন্য আলাদা আলাদা রেফারেল কোড থাকবে। সেই কোড ব্যবহার করেই নাম নথিভুক্ত করানো হবে। নেটওয়ার্ক গঠন সম্পূর্ণ হলেই ওই ১ লক্ষ ২৫ হাজার সদস্যকে নিয়ে ফের ভার্চুয়াল বৈঠকে বসবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্থাৎ ১১ জুলাইয়ের পরে যে কোনও দিন সেই বৈঠক বা সভা হতে পারে। কী ভাবে কাজ করতে হবে, ওই বৈঠকেই সে বিষয়ে বিশদ নির্দেশ পাবেন ‘যুবযোদ্ধা’রা। বাংলার যুবশক্তির সব সদস্যকেই এই ‘যুবযোদ্ধা’ নাম দেওয়া হচ্ছে।
নতুন কর্মসূচি তথা নেটওয়ার্কের লোগোও প্রকাশ করেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে কোথাও তৃণমূলের প্রতীক বা নাম ব্যবহার করা হয়নি। তৃণমূলের সঙ্গে সংস্রব রয়েছে, তা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে, এমন নয়। কিন্তু তৃণমূলের পৃষ্ঠপোষকতায় থেকেও এই নেটওয়ার্কের দরজা যে সবার জন্য খোলা, দলমত নির্বিশেষে সবার পাশেই যে দাঁড়াতে চায় বাংলার যুবশক্তি, সেই বার্তা দিতেই দলের প্রতীক বা নাম এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। ব্যাখ্যা তৃণমূল সূত্রের।
ঠিক সময়ে হলে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন আর ৮-৯ মাস দূরে। রাজ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ এই মুহূর্তে যে রকম, তাতে ২০২১-এর সেই নির্বাচনে তৃণমূলকে জোরদার লড়াইতেই যেতে হবে। সে কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই শুরু করেছেন তৃণমূলের পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর। লোকসভা নির্বাচনের পরে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি চালু করিয়েছিলেন পিকে। চলতি বছরে চালু করা হয়েছিল ‘বাংলার গর্ব মমতা’ নামে আর এক কর্মসূচি। এ বার ঘোষণা করা হল ‘বাংলার যুবশক্তি’। এই কর্মসূচি কিন্তু চরিত্রে কিছুটা আলাদা। দিদিকে বলো বা বাংলার গর্ব মমতার রূপায়ণের জন্য কোনও সমান্তরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়নি। তৃণমূলের সংগঠনকে কাজে লাগিয়েই চালানো হয়েছিল কর্মসূচি। এ বারও আগের দুটো কর্মসূচির মতোই সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হল, কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন এক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তার রূপায়ণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এতে লাভ কী? দলের যুব সংগঠনের এক নেতার ব্যাখ্যা— জনসংযোগ তো বাড়বেই, তার পাশাপাশি ভোটের আগে একটা সম্পূর্ণ নতুন জনভিত্তিও দলের সঙ্গে যুক্ত হবে। অর্থাৎ কর্মসূচি রূপায়ণ হবে, তৃণমূলের জন্য ১ লক্ষ ২৫ হাজারের নতুন যুববাহিনীও তৈরি হয়ে যাবে বিধানসভা নির্বাচনের আগে।
২১ জুলাইয়ের শহিদ স্মরণ সমাবেশের ক্ষেত্রেও বাংলার যুবশক্তি বড় ভূমিকা নিতে পারে বলে খবর। ১১ জুলাই শেষ হয়ে যাচ্ছে টিম তৈরির কাজ। তার ১০ দিন পরে তৃণমূলের শহিদ দিবস। ধর্মতলায় জমায়েত করার পরিস্থিতি যদি থাকে তখন, তা হলে এই নতুন নেটওয়ার্কই লক্ষাধিক যুবক-যুবতীকে ধর্মতলায় হাজির করতে পারবে সে দিন। আর যদি ভার্চুয়াল সমাবেশ হয়, তা হলেও ১ লক্ষ ২৫ হাজার ‘যুবযোদ্ধা’ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে শামিল হতে পারবেন সেই সভায়। অতএব এই নতুন কর্মসূচি তথা নেটওয়ার্ক অনেকটাই এগিয়ে রাখতে চলেছে শহিদ স্মরণের আয়োজনকে, মত তৃণমূল যুব কংগ্রেস কর্মীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy