আরজি কর-কাণ্ডের তিন মাস পার। বিচারের দাবিতে পথে জুনিয়র ডাক্তার থেকে সাধারণ মানুষ। —নিজস্ব চিত্র।
আরজি কর-কাণ্ডের পর তিন মাস পেরিয়েছে। সেই ঘটনার প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনেরও তিন মাস। শনিবার তিন মাস পার হওয়ার দিনে আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে শুধুই আক্ষেপ! এখনও তাঁদের একটাই প্রশ্ন, ‘বিচার কোথায়?’ এই বিচার চেয়েই শনিবার তিনটি কর্মসূচির ডাক দেয় ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার ফ্রন্ট (ডব্লুবিজেডিএফ)। সেখানে ফ্রন্টের সদস্যদের পাশাপাশি বিচারের দাবিতে পথে নামেন সাধারণ মানুষ থেকে বিশিষ্টজনেরাও। মিছিল শেষে জুনিয়র ডাক্তারেরা জানিয়ে দেন, বিচারের দাবিতে আগামী দিনেও চলবে আন্দোলন।
গত ৯ অগস্ট আরজি কর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চারতলার সেমিনার হল থেকে উদ্ধার হয় এক মহিলা চিকিৎসক-পড়ুয়ার দেহ। তাঁকে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে। ওই দিন থেকেই প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেন রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলির জুনিয়র ডাক্তারেরা। শনিবার, ৯ নভেম্বর সেই ঘটনার তিন মাস পার হওয়ার দিনে তিনটি কর্মসূচি ছিল— রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ‘দ্রোহের গ্যালারি’, কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল এবং ‘অভয়া মঞ্চ’-এর ‘জনতার চার্জিশিট’। এই তিনটি কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল একটাই, নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচারের দাবি। আন্দোলনকারীদের দাবি, তিন মাস পেরিয়ে গেলেও বিচার অধরাই রয়েছে। জুনিয়র ডাক্তারেরা বার বার দাবি তুলেছেন, আরজি করে চিকিৎসকের উপর যে নির্যাতন চলেছিল, তা একা কারও পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। আরজি করের ঘটনাকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধ’ বলেও দাবি করেছেন তাঁরা। তাই দ্রুত বাকি ‘দোষী’-দের ধরার দাবিও তুলেছেন। যদিও সিবিআইয়ের চার্জশিটে আরজি করে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের নামেরই শুধু উল্লেখ করা হয়েছে। নিজেদের এই দাবিগুলিতেই শনিবারের মিছিলে সরব হন আন্দোলনকারীরা।
শনিবারের কর্মসূচিতে স্বতস্ফূর্ত ভাবে যোগ দেন সাধারণ মানুষও। কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের সঙ্গে পা মেলান তাঁরা। কারও হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড, কারও মুখে শোনা গিয়েছে স্লোগান। প্রায় সকলের কণ্ঠেই শোনা গিয়েছে আক্ষেপ, ‘বিচার কোথায়’।
তবে প্রশ্ন উঠেছে, ২৫ দিন আগের ‘দ্রোহের কার্নিভাল’-এর সেই প্রতিবাদের তীব্রতা কি একটু হলেও স্তিমিত শনিবার? প্রতিবাদীদের একাংশ মনে করছেন, গত ১৫ অক্টোবর ‘দ্রোহের কার্নিভাল’-এর সময় ধর্মতলা এবং উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে অনশন করছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। ৫ অক্টোবর থেকে ধর্মতলায় ১০ দফা দাবিতে চলছিল তাঁদের অনশন। তার মাঝে ১৫ অক্টোবর প্রতিবাদীদের ডাক দেওয়া ‘দ্রোহের কার্নিভাল’ কর্মসূচিতে ছিল পুলিশ এবং প্রশাসনের বাধা। সেই কর্মসূচির অনুমতি পেতে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল আন্দোলনকারীদের। শেষ পর্যন্ত হাই কোর্টের নির্দেশে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ থেকে সরে যায় কলকাতা পুলিশের ব্যারিকেড, শিকল। তার কয়েকশো মিটার দূরে রেড রোডে সে দিন ছিল দুর্গাপুজোর কার্নিভাল। তার সঙ্গে ‘প্রতিযোগিতা’রও একটি বিষয় ছিল। প্রতিবাদীদের ওই অংশের মতে, এই সব প্রতিবন্ধকতা জয় করার আবেগই উঠে এসেছিল ১৫ অক্টোবরের প্রতিবাদে। সে দিক থেকে শনিবারের কর্মসূচির জন্য কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি প্রতিবাদীদের। কলেজ স্কোয়্যার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত রাস্তার এক দিক দিয়ে হেঁটে এসেছেন প্রতিবাদীরা। অন্য দিক দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে গাড়ি চলাচল করেছে। মিছিলে হেঁটে এসে ধর্মতলায় ‘জনতার চার্জশিট’ কর্মসূচিতে যোগ দেন সাধারণ মানুষ। শান্ত ভাবেই পথে বসে দেখেন নাটক। শোনেন চিকিৎসকদের বক্তৃতা।
যদিও আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ-আন্দোলনে শামিল হওয়া অনেক পরিচিত জনকে শনিবারের কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে জুনিয়র ডাক্তার স্নিগ্ধা হাজরা জানান, সামনে পরীক্ষা থাকার কারণে জুনিয়র ডাক্তার এবং ডাক্তারি পড়ুয়াদের অনেকে যোগ দিতে পারেননি শনিবারের কর্মসূচিতে। স্নিগ্ধার কথায়, ‘‘এমবিবিএস তিনটি ইয়ার, এমডি ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা রয়েছে। পরীক্ষা যাঁদের চলছে, তাঁরা আসতে পারবেন না। আমিও ডিউটি করে একটু দেরিতে যোগ দিয়েছি।’’ তবে স্নিগ্ধা স্পষ্টই জানান, জনতা তাঁদের সঙ্গে রয়েছে। আর আপাতত আন্দোলন থেকে সরছেন না তাঁরা। ধর্মতলায় ৫ থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত অনশনে বসেছিলেন স্নিগ্ধা। তাঁর কথায়, ‘‘রাজপথেই থাকব। আন্দোলন ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।’’
স্নিগ্ধার সুরেই পথে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন আন্দোলনকারী চিকিৎসক দেবাশিস হালদার। তিনিও বলেন ‘‘রাজপথ ছাড়ব না।’’ আর এক জুনিয়র ডাক্তার পুলস্ত্য আচার্য বলেন, ‘‘মনে রাখবেন আমাদের আন্দোলন চলছে। চলবে। আমাদের সঙ্গে জনতার চার্জশিট কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করুন। এই আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আন্দোলন বিচারের দাবিতে।’’
ধর্মতলায় অনশনে বসেছিলেন পুলস্ত্যও। পরীক্ষার কারণে শনিবারের মিছিলে দেখা যায়নি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের। পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁরা জানান, শনিবার রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয় তাঁদের কলেজে। সেখানে প্রায় ১৫০ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া আয়োজন করা হয়েছে ‘দ্রোহের গ্যালারি’র। তার পরেই তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, আন্দোলন এখনই থামছে না। বিচার না পাওয়া পর্যন্ত ক্রোধের আগুন জ্বলবে।
‘দ্রোহের গ্যালারি’
শনিবার কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ‘দ্রোহের গ্যালারি’ করার ডাক দেন জেডিএফের সদস্যেরা। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের বিভিন্ন ছবি, পোস্টার, ব্যানার, কবিতা, শিল্প, স্থাপত্য প্রদর্শিত হয়েছে রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে। আন্দোলনের সে সব ছবি পাঠানোর জন্য বলেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সেই ডাকেই বহু মানুষ ছবি তুলে পাঠিয়ে দেন, যা প্রদর্শিত হয় রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে। ফ্রন্টের সদস্যেরা জানিয়েছেন, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে আন্দোলনের বিভিন্ন মুহূর্ত এবং মূল বিষয়টিকে ধরে রাখা হয়েছে। আরজি কর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনেও চলেছে প্রদর্শনী। এই জরুরি বিভাগ যে বিল্ডিংয়ে রয়েছে, তারই চারতলার সেমিনার হল থেকে গত ৯ অগস্ট উদ্ধার হয়েছিল ওই পড়ুয়া চিকিৎসকের দেহ। মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচির সময় এখানেই ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছিল।
ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল
নির্যাতিতা চিকিৎসকের জন্য ন্যায়বিচারের দাবিতে শনিবার দুপুর ৩টের কিছু পরে কলেজ স্কোয়্যার থেকে মিছিল শুরু করেন ফ্রন্টের সদস্যেরা। ধর্মতলা পর্যন্ত হাঁটেন আন্দোলনকারী চিকিৎসক দেবাশিস, স্নিগ্ধা, পুলস্ত্য, পরিচয় পণ্ডা, অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়েরা। স্নিগ্ধা, পরিচয়, পুলস্ত্য এবং অনুষ্টুপ ধর্মতলায় অনশন করেছিলেন। মিছিলে তাঁদের সঙ্গে পা মেলান সাধারণ মানুষ। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের হাতে প্ল্যাকার্ডের পাশাপাশি ছিল ভারতের সংবিধান। সামনের সারিতে ন্যায়ের মূর্তি হাতে হাঁটতে দেখা যায় এক জুনিয়র ডাক্তারকে। সাধারণ মানুষের কারও হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড, কারও হাতে জাতীয় পতাকা। মুখে স্লোগান, ‘বিচার চাই’। মিছিলে পা মেলান অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত, চৈতি ঘোষালেরাও। মিছিল থেকে উন্নাও, হাথরসের নির্যাতিতার জন্য বিচারের দাবিও ওঠে। মুরলীধর সেন লেনে বিজেপির দফতরের সামনে এসে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে ওই স্লোগান দেন প্রতিবাদীরা। পরিচিত আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের অনেককে দেখা যায়নি মিছিলে। সামনেই ডাক্তারি পরীক্ষা রয়েছে। সেই কারণে অনেক জুনিয়র ডাক্তার অনুপস্থিত বলে জানান তাঁদের সহপাঠী, সহকর্মীরা। মিছিল শেষে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারেরা একযোগে জানিয়ে দেন, রাজপথ তাঁরা ছাড়ছেন না। নির্যাতিতার জন্য বিচারের দাবিতে আন্দোলন তাঁদের চলবে।
‘জনতার চার্জশিট’
শনিবার ধর্মতলায় ‘জনতার চার্জশিট’ কর্মসূচি পালন করে ‘অভয়া মঞ্চ’। কয়েক সপ্তাহ আগে আরজি কর-কাণ্ডের বিচারের দাবিতে এক হয়ে ‘অভয়া মঞ্চ’ তৈরি করেছিল ৮০টিরও বেশি সংগঠন। তারাই ‘জনতার চার্জশিট’ কর্মসূচির ডাক দেয়, যেখানে পথনাটক, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়ের মধ্যে দিয়ে চলে প্রতিবাদ। আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ এবং খুনের মামলায় চার্জশিট দিয়েছে সিবিআই। শিয়ালদহ আদালতে চার্জ গঠনও হয়েছে। চার্জশিটে শুধু নাম রয়েছে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের। সেই চার্জশিট নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে ওই সংগঠন। সিবিআইয়ের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সংগঠনের সদস্যেরা নিজেদের মতো করে একটি চার্জশিট তৈরি করেছেন, সেখানে তুলে ধরেছেন আরজি কর-কাণ্ডের তদন্ত এবং বিচার নিয়ে নিজেদের অভিযোগ, আক্ষেপ, হতাশার কথা। সাধারণ মানুষ নিজেদের মতো করে অভিযোগ করেছেন। আঙুল তুলেছেন পুলিশ, প্রশাসন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি, রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে নির্বাচন বন্ধ, ‘হুমকি সংস্কৃতি’ নিয়েও অভিযোগ করেছেন সংগঠনের সদস্যেরা। লিখিত আকারে সেই ‘জনতার চার্জশিট’ প্রকাশও করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy