মুনমুন সাহা দোলই, বনকাটা, গড়বেতা, পশ্চিম মেদিনীপুর
রান্নাঘরের ঝুলকালি মুছে ঘরনিদের স্বস্তি দিতে নিখরচায় উজ্জ্বলা গ্যাসের সংযোগ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। আর সেই গ্যাসের দামের বাড়বৃদ্ধিতেই এখন ‘আগুন জ্বলছে’ বিপিএল পরিবারগুলির হেঁশেলে। ধুলো জমেছে আভেনে, লাল রঙা সিলিন্ডার মলিন। উনুন আর কাঠপাতার জ্বালানিই ভরসা গ্রাম বাংলার অধিকাংশ নিম্নআয়ের পরিবারে। বালতি, ঝুড়ি রাখতে কাজে লাগছে আভেন, সিলিন্ডার। অনেকে আবার দুই-ই বেচে দিয়েছেন।
রান্নার গ্যাস হাজার ছাড়িয়েছে। সরকারি ভর্তুকি মোটে সাড়ে উনিশ টাকা। স্থান ভেদে দামের হেরফের হলেও হাজারের নীচে নামছে না। এ কথা জেনে উজ্জ্বলার সরকারি বিজ্ঞাপনে যাঁদের কথা ফলাও করে বলা হয়, সেই মেয়ে-বউদের হাসি কিন্তু উধাও। অনেকেই দাম ৭০০-৮০০ হওয়ার পরই আর সিলিন্ডার কিনতে পারেননি।
শনিবার দুপুরে উনুনে রান্না সেরে তখন সবে উঠেছেন ইংরেজবাজার শহরের নেতাজি কলোনির বাসিন্দা উমা মণ্ডল। গ্যাস আছে তো, ব্যবহার করেন না? গামছায় ক্লান্ত মুখ মুছে উমার জবাব, “সিলিন্ডারের দাম যখন ৮৫০ টাকা ছিল, তখন শেষ ভরেছিলাম।” ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মালদহে গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ছিল ৮৬১ টাকা। এখন ১০৯৭ টাকা। আগে মুর্শিদাবাদে ১৪.২ কেজি রান্নার গ্যাসের দাম ছিল ৯৯৩.৫০ টাকা। শুক্রবার মধ্যরাতে ৫০ টাকা দাম বাড়ায় হয়েছে ১০৪৩.৫০ টাকা। এই অবস্থায় উজ্জ্বলা যোজনার বেশিরভাগ উপভোক্তারই আভেন আর সিলিন্ডার রান্নাঘরের এক কোণে ঠাঁই পেয়েছে। গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থাদের দাবি, ৪০-৪৫ শতাংশ উপভোক্তা নিয়মিত গ্যাস সিলিন্ডার নেন। হুগলির গোঘাটের গ্যাস ডিস্ট্রিবিউটর শ্যামসুন্দর নন্দী বলছেন, ‘‘আমার অধীনে উজ্জ্বলা গ্যাস প্রকল্পে ১৮ হাজার উপভোক্তা আছেন। বছর আড়াই আগেও উপভোক্তা পিছু বছরে ৬টি সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছে। এখন ৭০ শতাংশই বছরে ২টি সিলিন্ডার নিচ্ছেন।’’
গ্যাস কিনতে না পেরে আভেন ও সিলিন্ডার বিক্রি করে দিয়েছেন, এমন নজিরও আছে। বীরভূমের মুরারই থানার গোড়াশা গ্রামের অনীতা কোনাই মানছেন, ‘‘ঘরে থেকে নষ্ট হচ্ছিল। সিলিন্ডার ও আভেন তাই বেচে দিয়েছি।’’ দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক বা টোটো চালক পরিবারগুলিতে দিনে শ’তিনেক টাকা রোজগার। অনেকে পরিচারিকার কাজ করেন, কেউ বিড়ি বেঁধে সংসার চালান। দিন আনি দিন খাইয়ের সংসারে হাজার টাকার গ্যাস তাঁদের কাছে বিলাসিতা। লোকের বাড়ি রান্না করাই পেশা নবদ্বীপের বৈশাখী দত্তের। অথচ অগ্নিমূল্যের বাজারে নিজের ছেলেকে রান্না করে খাওয়াবেন কী করে, বুঝতে পারছেন না। তাঁর কথায়, “৬০০ টাকায় সিলিন্ডার কেনা শুরু করেছিলাম। এখন সিলিন্ডারের দাম হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেল। এ বার স্টোভে রাঁধতে হবে।”
অনেকে আবার ইতিমধ্যেই বিকল্প উপায় নিয়েছেন। কেউ শুধু ভাতটুকু গ্যাসে করে নিচ্ছেন। অনেকে আবার গ্যাসেই রাঁধছেন, তবে রান্নার পদ কমিয়েছেন বেশ কয়েকটি। পশ্চিম বর্ধমানের বাঁশড়া গ্রামে সুমিতা হেমব্রম যেমন জানালেন, “খরচ বাঁচাতে এক-দু’পদের বেশি রাঁধছি না।” দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘির দমকল গ্রামের বাসিন্দা রিক্তা পুরকাইতের কথায়, “এক বেলা গ্যাসে রান্না করি। রাতে কখনও জলভাত, কখনও শুকনো খাবার খাই।’’
দামও ৪৫৭.৫০ টাকা বেড়েছে। কংগ্রেসের বক্তব্য, এ সব থেকে নজর সরাতেই গত আট বছরে বিজেপি মানুষের শব্দকোষে নতুন নতুন শব্দ যোগ করেছে। যেমন, টুকরে টুকরে গ্যাং, লাভ জিহাদ, ঝটকা বনাম হালাল, হনুমান চালিসা বনাম আজান, বুলডোজ়ার। কারণ, এই সব বিষয় না তুললে, সমাজে অশান্তি তৈরি না করলে মানুষ মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অশান্ত হয়ে উঠবে।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে মোদী গ্যাসের দামবৃদ্ধি নিয়ে কংগ্রেসকে কটাক্ষ করে জনসভায় বলতেন, ‘ভোট দিতে যাওয়ার আগে গ্যাসের সিলিন্ডারে নমস্কার করবেন। ওরা মানুষের থেকে গ্যাস কেড়ে নিতে চাইছে।’ ভোটে জেতার পরে মোদী আমজনতার কাছে স্বেচ্ছায় রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি ছেড়ে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন। বিরোধীদের অভিযোগ, এ বার চড়া দামের জেরে সাধারণ মানুষকে রান্নার গ্যাস ব্যবহার করাই ছেড়ে দিতে হবে। আজ দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলনে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারে মালা পরিয়ে, সামনে ধূপকাঠি জ্বেলে কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরা বলেন, ‘‘পঁয়ষট্টি ঘণ্টায়
তিন দেশের সফর করে, বিশ রকম পোশাক পরে, ষাট বার ফোটোশ্যুট করে সাহেব ভারতে ফিরলেন। এসেই রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম বাড়িয়ে দিলেন!’’
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিকে ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান লুট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার অবিলম্বে দেশের মানুষের উপর এই অত্যাচার বন্ধ করুক। বারবার জ্বালানি, রান্নার গ্যাস, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে বিজেপি গ্রেট ইন্ডিয়ান লুট চালাচ্ছে।’’ তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র সুখেন্দুশেখর রায় বলেন, ‘‘এটা মুনাফাখোর সরকারে পরিণত হয়েছে। মানুষের উপর বোঝা চাপিয়ে ২০১৪ সাল থেকে ১৭ লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এই সরকার যে সংস্কারের রাস্তা নিয়েছে, আমরা তার সংস্কার চাইছি।’’
‘পেট্রলিয়াম প্ল্যানিং অ্যানালিসিস সেল’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মনমোহন সিংহ সরকারের শেষ বছর অর্থাৎ ২০১৩-১৪-য় রান্নার গ্যাসে ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি
টাকার বেশি ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল। মোদী সরকারের প্রথম বছর, ২০১৪-১৫-য় রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির
পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি। তার পরের বছরই ভর্তুকির পরিমাণ এক ধাক্কায় ১৮ কোটি টাকার কমে নেমে আসে।
তার পর থেকে ভর্তুকির অঙ্ক
নামমাত্র। গত অর্থ বছরের তথ্যই নেই। সরকারি সূত্রের দাবি, ২০২১-২২-এর প্রথম নয় মাসে রান্নার গ্যাসে
প্রায় ২,৭০৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি বাবদ ৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কত খরচ হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy