জয়ন্ত সিংহ ওরফে জায়ান্ট। —ফাইল ছবি।
ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, মহিলা ও তাঁর কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে প্রকাশ্য রাস্তায় মারধর করছে বাহুবলী। এই ঘটনার পরে গুরুতর জখম অবস্থায় ওই মা ও ছেলেকে নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়।
এই ‘দাদা’ জেসিবি নয়। জয়ন্ত সিংহ ওরফে জায়ান্ট। আড়িয়াদহ এলাকায় যে চালু করেছিল তার এমনই নিজস্ব ‘বিচার ব্যবস্থা’। এলাকার লোকেদের কথায়, যার এজলাস ছিল স্থানীয় তালতলা ক্লাব। সেখানে নিজস্ব ‘আদালত’ বসিয়ে, বহু লোককে মারধর করেছে জায়ান্ট, অভিযোগ স্থানীয়দের একাংশেরই। নাবালকও রেহাই পায়নি বলে অভিযোগ। সেই অত্যাচারের ভিডিয়ো ফুটেজও সামনে এসেছে। শেষ পর্যন্ত মা-ছেলেকে মারধরের ঘটনায় গ্রেফতার হয় জয়ন্ত।
পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের কথায়, উত্তর দিনাজপুরের জেসিবি থেকে উত্তর ২৪ পরগনার জায়ান্ট, এলাকায় শাসনের পদ্ধতি মোটামুটি একই। বাহুবল। এবং তাদের পিছনে রাজনৈতিক মদত।
জায়ান্ট বা জয়ন্ত যাঁর ঘনিষ্ঠ বলে প্রথম থেকে অভিযোগ উঠেছে, কামারহাটির বিধায়ক সেই মদন মিত্র একবার বলেছিলেন, ‘‘কামারহাটি এলাকায় সিপিএমের বিকল্প গুন্ডা আমরা তৈরি করেছি। গুন্ডা আমরা তৈরি করি। আমরা যদি মনে করি গুন্ডা তৈরি করব, তা হলে সে গুন্ডা। আর যদি মনে করি, ঘরে ঢুকিয়ে দেব।’’
বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক-নেতাদের এই ‘স্নেহ-পরশ’ পেয়েই জয়ন্তেরা এত বেপরোয়া। গুন্ডা আর দাদার ফারাক একটা সময় আর থাকে না। শাসকের ‘জামা’ গলিয়ে নিলেই যে গুন্ডা, সে হয়ে যায় ‘দাদা’। শেষে এলাকার নেতা।
বিরোধী শিবিরের দাবি, এলাকার ‘দাদা’ থেকে এলাকায় চূড়ান্ত প্রভাবশালী নেতা হওয়ার হালফিলের সবচেয়ে বড় উদাহরণ সন্দেশখালির শেখ শাহজাহান। এ বছর জানুয়ারিতে তৃণমূল নেতা শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশিতে এসেই আক্রান্ত হয়েছিলেন ইডি আধিকারিক ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা। তার পরে জল অনেক গড়িয়েছে। সামনে এসেছে ‘দাদার’ নানা কীর্তি। ‘শাহজাহান বাহিনী’র দাপট এতটাই যে, নাম শুনে ডরায় না, এমন মানুষ এ তল্লাটে পাওয়া কঠিন।
অথচ এক সময়ে দিন-আনি দিন-খাই অবস্থা ছিল শাহজাহানদের। উত্থান শুরু বাম জমানার শেষে। ২০১১ সালে ‘পরিবর্তনের’ ভোটেও সন্দেশখালি থেকে জিতেছিলেন সিপিএম নেতা নিরাপদ সর্দার। শাহজাহান ২০১৩ সালে দল বদল করেন। তার পর থেকে এলাকায় তৃণমূলের বাড়বাড়ন্ত ও তাঁর নিজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি যেন হাতে হাত ধরে হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, তাঁর সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’ বাড়ে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের। জমি দখল, মাছের ভেড়ি দখল থেকে শুরু করে বহু অভিযোগ ছিল শাহজাহানের বিরুদ্ধে। বিরোধীরা দাবি করেন, প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আগ্নেয়াস্ত্রের ভান্ডার ফুলে ফেঁপে ওঠে। এমনকি, তাঁর কিছু অনুগামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগও রয়েছে। তবে, ইডি-কাণ্ডের পর থেকে প্রতিরোধে নামেন গ্রামবাসী। ধরা পড়েন শাহজাহান।
এতটা না হলেও এলাকায় ‘নামডাক’ কম নয় বাবু দাসের! বীরভূমের কেষ্ট ওরফে অনুব্রত মণ্ডলের খাসতালুক বোলপুর-শান্তিনিকেতনের লোকজনই বলেন, তৃণমূলের নেতা হলেও বাবু ওরফে শ্যামপ্রসাদ দাস আসলে ‘দাদা’। হুমকি, শাসানি, মারধর, তোলা আদায়— অভিযোগের ফিরিস্তি দীর্ঘ। এই নিয়ে বোলপুর পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের পুর-প্রতিনিধির স্বামী বাবুর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন সোনাঝুরির হাটের ব্যবসায়ীরাও। লিখিত অভিযোগও হয়েছে অনেক বার। কিন্তু, কোনও অজ্ঞাত কারণে বাবুর বিরুদ্ধে পদক্ষেপই করে না পুলিশ। বাবু অবশ্য বলেন, “সবটাই বিরোধীদের অপপ্রচার।”
হুগলির আরামবাগ মহকুমায় তৃণমূলের এমন অনেক নেতার নামই চর্চায় উঠে আসে। যাঁদের কেউ ছিলেন লরিচালক, কেউ মাছ, গরু বা বেকারি ব্যবসায়ী। কেউ এমনকি প্রান্তিক চাষি বা দিনমজুর। শাসক দলের বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি বা দলীয় পদ পাওয়ার পরে বছর কয়েকের মধ্যে তাঁদের প্রতাপ এতটাই বেড়েছে বলে দাবি যে, তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে কেঁপে ওঠেন মানুষ। তাঁদের বিরুদ্ধেও তোলা আদায়, বিরোধী বা দলেরই প্রতিবাদীদের মারধর-সহ নানা অভিযোগ রয়েছে। আছে পুলিশকে শাসানির নজিরও। গত মে মাসে আরামবাগের তিরোল পঞ্চায়েতের পূর্ত সঞ্চালক মহম্মদ ইমরানের বিরুদ্ধে তোলা না-পেয়ে এক ঠিকাদারকে মারধরের অভিযোগ ওঠে। সেই মামলা চলছে। ইমরানের দাবি, “আমার ও দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই মিথ্যা অভিযোগ।”
মুর্শিদাবাদের নওদার এক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে বিরোধীদের তো বটেই, দলের নেতা-কর্মীদেরও মারধরের অভিযোগ আছে। আছে জনপ্রতিনিধি, সরকারি আধিকারিকদের মারধরের নালিশ। দু’-এক বার থানায় অভিযোগ হলেও তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান রবিউল আলম চৌধুরী বলেন, ‘‘কারা দাদাগিরি করছে, কারা প্রোমোটাররাজ কায়েম করেছে, সেই নাম বিরোধীরা বলুক। দলের কেউ অন্যায় করলে দল ব্যবস্থা নেবে।’’
আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে আবার অন্য ‘দাদাগিরি’। সেই ‘দাদা’ হল শ্রমিক সংগঠন। বাম জমানা থেকে চলে আসা সেই ‘রীতি’ আজও রয়েছে। শ্রমিক-কর্মীদের সূত্রের দাবি, গত কয়েক বছরে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে ‘দাদাগিরি’ চরমে উঠেছে। শাসক দলের স্থানীয় শ্রমিক নেতারা নিজেদের লোক নিয়োগের জন্য বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষকে চাপ দেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে বহিরাগত লোক নিয়োগ করেন ওই নেতারা। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন কারখানার সামনে এলাকাবাসী বার বার বিক্ষোভও করেছেন।
তৃণমূল সূত্রের খবর, সম্প্রতি দুর্গাপুরে এসে দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আইএনটিটিইউসি-র কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নেতাদের কাছে। শ্রমিক সংগঠনের ‘দৌরাত্ম্যে’ রাশ টানতে দলের কয়েক জন জেলা নেতাকে দায়িত্বও দিয়ে যান। তাতেও যে পুরোপুরি ‘রাশ’ টানা গিয়েছে দাদাগিরিতে, এমনটা নয়, জানাচ্ছেন সাধারণ শ্রমিক-কর্মীরাই। গত কয়েক দশকে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলও এমন অসংখ্য ‘দাদার কীর্তি’ দেখেছে। দেখেছে বেহালা, হরিদেবপুরের মতো আরও অনেক এলাকা।
বিভিন্ন দলের নেতারাই বলছেন, ‘দাদাগিরির’ শিকড় এতই গভীরে যে, তাকে চট করে উপড়ে ফেলা কঠিন। ‘দাদারা’ই যে এখন রাজনীতির চালক! ভোট বৈতরণী পারের হাতিয়ারও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy