—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ওষুধের বিপদ কি শুধু এক দিক থেকেই আসে? শুধুই কি সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স-এর মাধ্যমে কেনা ওষুধের গুণমান নিয়েই সংশয়? একেবারেই না। স্বাস্থ্য দফতরের একের পর এক ‘কেলেঙ্কারি’ এখন সামনে আসছে এক এক করে।
আর জি কর হাসপাতালের কর্মীদেরই একটা অংশ অভিযোগ করেছেন, সরকারি টাকায় কেনা ওষুধ হাসপাতাল থেকে রাতের পর রাত গাড়ি বোঝাই করে বেরোত। বেরোত সরঞ্জামও। সকলের চোখের সামনে দিয়েই। এ ব্যাপারে অভিযোগও জমা পড়েছিল বার কয়েক। কিন্তু কিছুই হয়নি। এক দিকে বেরোত, আর অন্য পথে কখনও কখনও ঢুকত কিছু ওষুধ, যা কোথা থেকে কেনা, কী গুণমান— তা যাচাই-ই হত না। হাসপাতালের এক প্রাক্তন কর্তার কথায়, ‘‘এক ওষুধ বাইরে বেচে যে ওষুধ আনা হত, তা জাল কি না, সেটা কে বলবে? নজরদারির কোনও ব্যবস্থাই তো ছিল না। রোগীদের গিনিপিগ বানিয়ে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন। গরিব মানুষ। তাঁদের ক’জনই বা প্রতিবাদ করার কথা ভাবেন? তাঁদের সঙ্গে যে কোনও অন্যায় হচ্ছে, বহু ক্ষেত্রে সেটাই তো তাঁরা বুঝতে পারেন না!’’
গত বছর আর জি করে পর পর কয়েকটি সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যু হয়। সেই সময়ে একটি ইন্ট্রাভেনাস অ্যানেস্থেটিক ওষুধের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ওই একই ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আরও কয়েকটি হাসপাতাল থেকেও রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছিল। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গড়া হয়। তার পর? সে তথ্য জানতে চাইলে কর্তাদের দায় ঠেলাঠেলি ছাড়া আর কিছু সামনে আসে না। ঠিক যে ভাবে সামনে আসে না, গত এক বছরে বিভিন্ন হাসপাতালে হিস্টেরেক্টমি, মায়োমেক্টোমির মতো অস্ত্রোপচারের পরে একাধিক রোগিণীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। আর জি করকে একা কাঠগড়ায় দাঁড় তুলে লাভ নেই, অনিয়ম শিকড় ছড়িয়েছে সর্বত্র। বিভিন্ন হাসপাতালের অভিযোগের ফাইল ঘাঁটলে দেখা যাবে, ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত অভিযোগ অজস্র। তার বেশির ভাগেরই তদন্ত হয় না।
অথচ খোঁজ করতে গেলে বোঝা যায় নিয়মের বজ্র আঁটুনির কোনও শেষ নেই। বরাত পাওয়ার জন্য ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস’ মেনে চলতে হয় এবং সেই সংক্রান্ত শংসাপত্র পেশ করতে হয়। এরই পাশাপাশি সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন এবং রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল-এর নিয়ম মেনে ‘রিস্ক বেসড ইন্সপেকশন’ করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় ওষুধটি তৈরির সময় থেকে ব্যবহার করা পর্যন্ত প্রত্যেক স্তরে যাবতীয় নিয়ম মানা হয়েছে কি না, তা যাচাই করে নেওয়া হয়।
নিয়ম রয়েছে এর পরেও। ওষুধ কেনার সময় একটি ব্যাচের নমুনা পরীক্ষার জন্য রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হয়।
কিন্তু তার পর? দফতরের কর্তারাই স্বীকার করেছেন, সে ল্যাবরেটরির যা দশা, তাতে নতুন, উন্নত ওষুধ পরীক্ষার স্ট্যান্ডার্ড ফর্মুলাই থাকে না বহু ক্ষেত্রে। পরীক্ষার যন্ত্র কম। লোকবল কম। বাইরের রাজ্যে এনএবিএল স্বীকৃত কিছু ল্যাবরেটরিতে নমুনা পাঠানো হয় বটে, কিন্তু অভিযোগ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই রিপোর্ট আসার আগেই ওষুধের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়।
ড্রাগ কন্ট্রোলের এক কর্তা বলেন, ‘‘নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে যে কোনও সময়ে ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে দেখার কথা। একে বলে ‘র্যানডম স্যাম্পলিং’। রোগীকে নিরাপদ ওষুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সেই লোকবল কোথায়? গোটা রাজ্যের জন্য মাত্র ৯০ জন ইনস্পেক্টর। কী কাজ সম্ভব তাঁদের দিয়ে? তাই কার্যত কিছুই হয় না।’’
আর হাসপাতাল? অভিযোগ, সেখানে বহু ক্ষেত্রে মেঝেতে পড়ে থাকে স্যালাইনের বোতল। মেয়াদ ফুরনো ওষুধ অবলীলায় পৌঁছে যায় ওয়ার্ডে। নমুনা পরীক্ষার আগেই ওষুধ প্রয়োগ করা হয় রোগীর শরীরে। ওষুধ, ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরে রোগীর অবস্থার আচমকা অবনতি ঘটলে, তা দেখারও কেউ থাকেন না। বা দেখলেও তাঁদের অনেকেরই কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। ক্লিনিকাল ফার্মাকোলজির বিশেষজ্ঞ শান্তনু ত্রিপাঠি বলেন, ‘‘কোনও ওষুধের গুণমান নিয়ে চিকিৎসকের ন্যূনতম সন্দেহ হলে, তার ব্যবহার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করা উচিত। আর কোনও রোগীর ক্ষেত্রে তা যদি ইতিমধ্যেই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তবে সেই রোগীকে পর্যবেক্ষণে রেখে, কোনও বিরূপ উপসর্গ দেখলে দ্রুত যথাযথ চিকিৎসা শুরু করার কথা। ওই ব্যাচের সমস্ত ওষুধ, বিভিন্ন ওয়ার্ডে যা সরবরাহ করা হয়েছে, তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তুলে নেওয়ার কথা।’’ তিনি এ-ও বলেন, ‘‘নিয়ম হল, এমন কিছু ঘটলে হাসপাতাল সুপারিনটেন্ডেন্ট তৎক্ষণাৎ ড্রাগ কন্ট্রোলকে জানাবেন। ড্রাগ ইন্সপেক্টর এসে ওই ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে গুণমান পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন। সেই পরীক্ষার রিপোর্ট যদি জানায়, ওষুধটি নিম্নমানের ছিল, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সরকার সেই সরবরাহকারী সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করতে পারে। গুরুত্ব অনুযায়ী সরকার আইনমেনে অন্য শাস্তির ব্যবস্থার পথেও যেতে পারে।’’
বাস্তবে ঠিক কী হয়? হাসপাতালের কর্মীদের এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে, বিস্ময়ের দৃষ্টি ছাড়া আর কোনও উত্তর আসেনি। ওষুধ সংক্রান্ত নিয়মকানুন কর্মীদের জানানোরই কোনও ব্যবস্থা নেই কোথাও। অনিয়ম, অযত্ন, নিস্পৃহতার ছাপ প্রত্যেক পদক্ষেপে।
অথচ সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর গুণগান গেয়ে প্রশাসনের তরফে প্রচারের শেষ নেই। স্বাস্থ্য দফতরের এক প্রাক্তন আমলা বলেন, ‘‘কোনও অভিযোগ উঠলেই বার বার বলা হয়, এ রাজ্যে সব নিখরচায় মেলে। কিন্তু সকলের জন্য সব ফ্রি করার তো দরকার নেই। গরিব মানুষ, যাঁদের চিকিৎসা খাতে ন্যূনতম খরচেরও সামর্থ্য নেই, তাঁরা নিখরচায় পান। কিন্তু যাঁদের আর্থিক অবস্থা তুলনায় ভাল, তাঁরা কেন ফ্রি পাবেন সরকারি হাসপাতালে? সব কিছুতে খয়রাতি না করে বরং চিকিৎসার মানের দিকে নজর দিক সরকার। তাতে অন্তত নিম্নমানের ওষুধ বা জাল ওষুধ খেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে না কাউকে।’’ তিনি বলেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালগুলির অধিকাংশই নির্লজ্জ রোগী শোষণের সঙ্গে যুক্ত। অনৈতিক ভাবে বিল বাড়ানো, প্রয়োজন না থাকলেও ব্যয়সাপেক্ষ পরীক্ষানিরীক্ষা, এমনকি অস্ত্রোপচারও করানোর অভিযোগ ওঠে অধিকাংশ হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা তো সরকারি হাসপাতালই। সেখানে মানুষের জীবনের দাম এত সস্তা হবে কেন?’’
‘‘মানুষের জীবনের দাম সস্তা’’— এই আক্ষেপ বহু সরকারি চিকিৎসকের মুখে শোনা যায়। তাঁরা প্রকাশ্যে সরব হতে সাহস পান না, আর হলেও শাস্তির মুখে পড়েন। যাঁরা মানতে পারেন না, তাঁদের কেউ কেউ এই ব্যবস্থা থেকেই নিজেকে সরিয়ে নেন। এ রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বহু বছর যুক্ত ছিলেন হেমাটোলজিস্ট প্রান্তর চক্রবর্তী। বর্তমানে শুধু সরকারি চাকরি নয়, এই রাজ্য ছেড়েই চলে গিয়েছেন তিনি। বর্তমানে তামিলনাড়ুর তিনকাশিতে গ্রামে গ্রামে রক্তের ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদেরচিকিৎসা করেন।
প্রান্তরের কথায়, ‘‘ওষুধের মান নিয়ে বার বার অভিযোগ করেছি। চাইল্ডহুড অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক অ্যানিমিয়া আক্রান্ত বাচ্চারা, যারা ভাল হয়ে উঠছিল, হঠাৎ করেই তাদের অবস্থার অবনতি হতে দেখছিলাম। অথচ সেটা হওয়ার কথাই নয়। একই ওষুধ, একই প্রোটোকল, তাতে যে সব শিশুর সুস্থ হয়ে ওঠার কথা, তাদেরই অনেকে মারা যাচ্ছিল। এর কোনও ব্যাখ্যা ছিল না আমাদের কাছে। বার বার বলেছিলাম ওষুধে সমস্যা হচ্ছে। প্রতিকার পাইনি। ডাক্তার হিসেবে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।’’
প্রান্তর মানতে পারেননি। আরও অনেকেই পারেন না। কিন্তু ‘সিস্টেমে’ থেকে যান। এ ভাবেই চলছে বছরের পর বছর। আর জি করের চিকিৎসক-পড়ুয়া তাঁর জীবন দিয়ে যে একের পর এক দুর্নীতির পর্দা সরাতে পরোক্ষে সাহায্য করলেন, তার শেষ কোথায়? এত আন্দোলন,এত প্রতিবাদের পরেও আদৌ কি কিছু বদলাবে? এই সংশয় সাধারণ মানুষের। অসুখে সরকারি হাসপাতালই যাঁদের একমাত্র আশ্রয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy