Advertisement
E-Paper

দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্যে নেতা-মন্ত্রীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, প্রভাবশালী যোগে অনুঘটকের ভূমিকায় কারা?

শিক্ষকনিয়োগ থেকে কয়লা বা গরু পাচার, পুরনিয়োগ থেকে খাদ্যবণ্টন দুর্নীতি— বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে ‘অনুঘটক’-দের ভূমিকা প্রকাশ্যে আসছে। তাঁদের তালিকা নেহাত খুব ছোট নয়।

Corruption

নানা দুর্নীতির অভিযোগে দীর্ঘ ‘অনুঘটক’-এর তালিকা। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:০৬
Share
Save

ঘটনা অনেক। অনুঘটক আরও বেশি। কয়লা থেকে গরু পাচার, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী থেকে পুরনিয়োগ হয়ে আপাতত রাজ্য রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে খাদ্যবণ্টন দুর্নীতি নিয়ে। যে দুর্নীতির তদন্তের সূত্রে বৃহস্পতিবার সাতসকালে প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সল্টলেকের দু’টি বাড়িতে হানা দিয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। কলেজ স্ট্রিট এলাকায় জ্যোতিপ্রিয়ের আদি বাড়িতেও তল্লাশি করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরা গিয়েছেন জ্যোতিপ্রিয়ের আপ্তসহায়ক অমিত দে-র নাগেরবাজারের ফ্ল্যাটেও।

ইডি সূত্রের দাবি, রেশন দুর্নীতির তদন্তে ইতিমধ্যেই ধৃত বাকিবুর রহমান নামের ব্যবসায়ীকে জেরা করেই জ্যোতিপ্রিয়ের নাম মিলেছে। বাকিবুরের হাজার কাঠার উপর জমির সন্ধান মিলেছে বলে ইডি সূ্ত্রের দাবি। কিন্তু শুধু বাকিবুরই নন। এখনও পর্যন্ত যে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তার সবক’টি তদন্তেই প্রকাশ্যে এসেছে এক এক জন নেতার সঙ্গে একাধিক ‘অনুঘটক’-এর যোগাযোগ। তাঁদের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ কোনও নেতার দেহরক্ষী আবার কেউ কোনও বেসরকারি সংস্থার কর্তা।

কয়লা পাচারের তদন্ত সূত্রে একটা সময়ে তল্লাশি, ডাকাডাকি ছিল রুটিন খবর। সেই তদন্ত সূত্রেই একদা যুব তৃণমূল নেতা বিনয় মিশ্রর নাম সামনে এসেছিল। বিনয়কে অবশ্য ছুঁতে পারেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। শোনা যায়, তিনি প্রশান্ত মহাসাগরীয় এক দ্বীপরাষ্ট্রে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। বিনয়ের ভাই বিকাশকে গ্রেফতার করেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। পরে তিনিও জামিন পান। বিনয়ের সঙ্গে পুরুলিয়ার ব্যবসায়ী অনুপ মাঝি ওরফে লালার যোগ ছিল বলে অভিযোগ। লালা আপাতত আদালতের রক্ষাকবচ পেয়ে বাইরে থাকলেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা বার বার আদালতে দাবি করেছে শাসক, পুলিশ, এবং কয়লাখনি কর্তাদের নিবিড় সমন্বয়ের ফলেই দিনের পর দিন কয়লা পাচার হয়েছে।

প্রসঙ্গত, কয়লা পাচারের তদন্ত সূত্রে তৃণমূলের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ইডি-র জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল তাঁর স্ত্রী রুজিরা নারুলাকেও। একটা সময়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অভিষেকের সঙ্গে বিনয়ের ‘সখ্য’ নিয়ে নানা কথা বলতেন। কিন্তু কয়লা পাচার মামলায় কলকাতার সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরার পর অভিষেক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, বিনয়ের সঙ্গে শুভেন্দুর কথোপকথনের ‘অডিয়ো ক্লিপ’ তাঁর কাছে রয়েছে। ‌দরকারে তিনি সেটি আদালতে জমা দিতে পারেন। অভিষেকের সেই হুঁশিয়ারির পরে শুভেন্দুকেও আর সে ভাবে বিনয়ের নাম নিয়ে কিছু বলতে শোনা যায় না।

লালা রক্ষাকবচ পেলেও তাঁর বেশ কয়েক জন সাগরেদকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। একটা সময়ে লালার ডেরা থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরি নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। পরে অবশ্য তা স্তিমিত হয়ে যায়। কারণ, কয়লা পাচারের বদলে ২০২২ সালের জুলাই থেকে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে শিক্ষকনিয়োগ দুর্নীতিতে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি। এই দুর্নীতিতেও অনেক ‘অনুঘটক’-এর ভূমিকা রয়েছে বলে দাবি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার। কখনও সামনে এসেছে এসএসসি-র উপদেষ্টা কমিটির কথা। আবার প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রকাশ্যে এসেছে ওএমআর শিট প্রস্তুতকারক সংস্থার জালিয়াতির কথা। পার্থের পাশাপাশি নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে বন্দি হয়ে জেলে রয়েছেন পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক তথা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য, বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা। তদন্তকারী সংস্থা বার বার আদালতে দাবি করেছে, মন্ত্রী থাকালীন পার্থ বাকিদের জড়িয়ে নিয়েই সবটা করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের তালিকা দীর্ঘ। শান্তিপ্রসাদ সিংহ, অশোক সরকার, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, তাপস মণ্ডল, প্রসন্ন রায়, কুন্তল ঘোষ, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’— অনেক নাম।

শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির তদন্ত সূত্রেই আর এক অনুঘটক অয়ন শীলের নাম সামনে আসে। সেই অয়নের সূত্রে আবার সামনে আসে পুরনিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ। যে তদন্তে ইতিমধ্যেই অসংখ্য পুরসভার দফতর, বর্তমান ও প্রাক্তন চেয়ারম্যানদের বাড়িতে হানা দিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার আধিকারিকেরা। পুরনিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষের বাড়িতেও দিনভর তল্লাশি চালিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।

সমান্তরাল ভাবে রাজ্যে গরু পাচার মামলাতেও তদন্ত চলেছে। এখনও চলছে। সেই তদন্তের সূত্রেই গ্রেফতারির পর আসানসোল জেল হয়ে আপাতত তিহাড় জেলে রয়েছেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর কন্যা সুকন্যাও জেলে রয়েছেন। গরু পাচারের তদন্তেও অনুঘটকের নাম নেহাত কম নয়। এনামুল হক, আবদুল লতিফদের ‘পাচারের মাথা’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে সিবিআই এবং ইডি। তারা এ-ও দাবি করেছে, এনামুলদের সঙ্গে অনুব্রতের ‘সেতুবন্ধন’ করে দিয়েছিলেন তাঁর দেহরক্ষী সহগল হোসেন । সহগলও এখন তিহাড় জেলে। যদিও এনামুল আদালতের রক্ষাকবচ পেয়ে আপাতত বাইরে রয়েছেন।

সিবিআইয়ের খাতায় ‘ফেরার’ ছিলেন বীরভূমের ব্যবসায়ী লতিফ। কিন্তু বিজেপি নেতা তথা ব্যবসায়ী রাজু ঝা খুনের সময়ে শক্তিগড়ের অকুস্থলে তিনি ছিলেন বলে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে। তার পরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন। অনুব্রতের হিসাবরক্ষক মণীশ কোঠারিকেও গ্রেফতার করেছিল ইডি। যদিও কিছু দিন আগে তিনি জামিন পেয়েছেন।

খাদ্যবণ্টন দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত সূত্রে যখন ইডি জ্যোতিপ্রিয়ের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে, তখন অনেকেই অন্য দুর্নীতির ঘটনা ও এবং তার সঙঅগে জড়িত বিভিন্ন অনুঘটকের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। যদিও জ্যোতিপ্রিয় আগেই বলেছেন, তিনি বাকিবুরকে চেনেন না! যে ভাবে তাঁর নাম জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তা আসলে ঘৃণ্য রাজনীতির নকশা। কিন্তু বাংলায় যত দুর্নীতির অভিযোগ, ততই দীর্ঘ অনুঘটকদের তালিকা। যাঁরা ‘সেতু’ গড়ে দিতেন বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে।

বিরোধীরাও সামগ্রিক ভাবে নেতাদের সঙ্গে ‘অনুঘটক’দের যোগকে অভিন্ন নকশা হিসাবে দেখছেন। রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আসলে অনুঘটকেরা নেতাদেরই মুখ। নেতারা নেপথ্যে থেকে এঁদের দিয়ে সব করিয়েছেন।’’ কংগ্রেস মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায় বলেন, ‘‘দুর্নীতি-যোগে তৃণমূলের যে নেতাদেরই নাম জড়াচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, তাঁদের আপ্তসহায়ক, দেহরক্ষী বা ঘনিষ্ঠদের বিপুল সম্পত্তির হদিস মিলছে। প্রশ্ন হল, আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন বিপুল সম্পত্তি তাঁরা করে ফেললেন, অথচ রাজ্য সরকারের পুলিশ, গোয়েন্দা দফতর কিছু জানত না?’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘গোটাটাই পরিকল্পিত। এক এক জনকে সামনে রেখে এক এক জন নেতা সব করেছেন।’’

তৃণমূল অবশ্য পাল্টা বিঁধেছে বিজেপি ও সিপিএমকে। শাসকদলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘সিপিএম, বিজেপি কাচের ঘরে বসে ঢিল ছুড়ছে। সিপিএমের নেতাদের পাশে কোন ব্যবসায়ীরা ঘুরতেন? ষাট্টা ডন রশিদ খান কার লোক ছিলেন? শুভেন্দু অধিকারী ঘনিষ্ঠ রাখাল বেরার কত সম্পত্তি? আসলে ওরা উন্নয়ন, জনস‌ংযোগে পারছে না, তাই এ সব আজগুবি গল্প বলছে।’’

Corruption West Bengal Partha Chatterjee Anubrata Mandal jyotipriyo mullick Manik Bhattacharya

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।