বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আইনজীবীদের বলেছিলেন, এমন সব অনিয়ম দেখার পরেও কোনও বিচারপতিই এই চেয়ারে বসে চুপ থাকতে পারে না! তাঁর পক্ষেও সম্ভব নয়। বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘এই সব মামলায় ঘুমানোর আগে আদালতকে অনেক মাইল যেতে হবে!’’
ডিভিশন বেঞ্চের দিকে আঙুল তুলে লাভ নেই। সিঙ্গল বেঞ্চের রায় পছন্দ না হলে ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়া হবে এটাই তো নিয়ম গ্রাফিক- সৌভিক দেবনাথ
কেউ বলছেন ‘দাবাং’ বিচারপতি। কেউ আবার হাই কোর্টে ছবি নিয়ে খুঁজছেন ওই বিচারপতিকে। অনেকে আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচারপতিকে আমাদের ‘হিরো’ বলে অভিহিত করছেন। কারও কথায়, তিনি বেকারদের ‘বাহুবলী’! কারও কারও মতে, ওই বিচারপতি তো বেকারদের চোখের জল মোছার কাজ শুরু করেছেন! আবার কেউ কেউ মনে করছেন, উনি রাজনৈতিক নেতাদের মতো ‘জনপ্রিয়’ হতে চাইছেন! এ ভাবেই নানা মুনির নানা মতের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এ বার সেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবকে চিঠি দিলেন তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্য বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অশোককুমার দেব।
অশোকের বক্তব্য, হাই কোর্টের মধ্যে বিষয়টিকে সীমাবদ্ধ না রেখে স্কুল নিয়োগ মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রশাসনিক নির্দেশে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে উপেক্ষা করে। অশোক বলেন, ‘‘বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের রায় নিয়ে আমরা কোনও মন্তব্য করব না। কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চের বিরুদ্ধে তিনি যে প্রশাসনিক নির্দেশ দিয়েছেন তা মেনে নেওয়া যায় না। এর ফলে বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা চাই বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকুক। সেই বিষয়েই আমরা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হয়েছি।’’
বার কাউন্সিলের চিঠিতে অশোক জানান, ডিভিশন বেঞ্চের বিরুদ্ধে সিঙ্গল বেঞ্চের এই বিদ্রোহে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে তাঁদের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ক্ষতি হচ্ছে বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণার। বিশেষ করে স্কুল সার্ভিস কমিশন সংক্রান্ত মামলায়। ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে অখুশি হলে মামলাকারীদের সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পথ খোলা ছিল। কিন্তু তাঁরা সেখানে যাননি বলে অশোকের দাবি। তাঁর মতে, সেটা হলে তা হত বিচারের পক্ষে শোভনীয়তা! এখন যা হচ্ছে তাতে দেখতে হবে রাজ্য সরকারকে হেয় করার কোনও উদ্দেশ যেন না থাকে।
এই মত প্রসঙ্গে আইনজীবীদের একাংশ বলছেন, ডিভিশন বেঞ্চে দিকে আঙুল তুলে লাভ নেই। সিঙ্গল বেঞ্চের রায় পছন্দ না হলে ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়া হবে এটাই তো নিয়ম। সেই কারণেই সংবিধান ডিভিশন বেঞ্চকে বাড়তি ক্ষমতা দিয়েছে। এখন সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করাতে অন্যায় কোথায়। আইনজীবী সঞ্জয় বর্ধনের যুক্তি, ‘‘বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিচারব্যবস্থায় গরিষ্ঠ বিচারপতিদের আদেশ বা রায়ের শালীনতা, উপযুক্ততা এবং মান্যতা বজায় রাখা বিচার প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর ব্যতিক্রম বিচারালয়ের সন্মান ও গৌরব নষ্ট হয়।’’
আবার ওই চিঠির বিষয়ে বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবীদের একাংশের আশঙ্কা, বার কাউন্সিল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস বয়কট বা ওই বেঞ্চ থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত মামলাগুলি সরানোর দাবি তুলতে পারে। ফলে তাঁরাও প্রধান বিচারপতিকে পাল্টা একটি চিঠি লিখে রেখেছেন। বলা হয়েছে, এমন কিছু ঘটলে তাঁরা মেনে নেবেন না। আগামী মঙ্গলবার এ বিষয়ে হাই কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন একটি বৈঠক করতে পারে।
প্রসঙ্গত, কয়েক দিন আগে একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বিচারবিভাগীয় এবং প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করেন। সেই নির্দেশে হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের ‘ভূমিকা’র কড়া সমালোচনা করেন তিনি। জানা গিয়েছে, ওই নির্দেশনামা পাঠানো হয় হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে।
সিঙ্গল ও ডিভিশন বেঞ্চের এই ‘বিতর্ক’-এর সূত্রপাত স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) কয়েকটি নিয়োগ মামলার শুনানিকে কেন্দ্র করে। প্রথমে গ্ৰুপ-ডি এবং পরে গ্ৰুপ-সি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআই অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছিল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের একক বেঞ্চ। বিচারপতি হরিশ টন্ডন এবং বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তের ডিভিশন বেঞ্চ ওই নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয়। পরিবর্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির মাথায় রাখা হয় কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগকে। তাঁর নেতৃত্বে বাকি সদস্যেরা হলেন আশুতোষ ঘোষ (পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের সদস্য), পারমিতা সাহা (মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ডেপুটি সেক্রেটারি), অরুণাভ বন্দ্যোপাধ্যায় (হাই কোর্টের আইনজীবী)।
সিবিআই অনুসন্ধানে স্থগিতাদেশের বদলে ওই কমিটি গঠন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবীদের একাংশ। আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের মতে, ‘‘ওই কমিটির তো তদন্ত করার পরিকাঠামো নেই। তা ছাড়া কমিটির অনেক সদস্যই শিক্ষা দফতরের। চোরকেই বলছি চোর ধরতে! সিবিআই অনুসন্ধানে স্থগিতাদেশ দেওয়ার ফলে হাই কোর্টের বদনাম হচ্ছে। বিচারব্যবস্থার মধ্যে ভয়ানক দুর্নীতি ঢুকে পড়ছে।’’
সব মিলিয়ে চারটি মামলায় সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। আবার এই সংক্রান্ত একটি মামলায় রাজ্যের তৈরি উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক শান্তিপ্রসাদ সিন্হার সম্পত্তির খতিয়ান দেখতে চান বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাতে ডিভিশন বেঞ্চ যে নির্দেশ দেয়, তাতে ক্ষুণ্ণ হন তিনি। ডিভিশন বেঞ্চ ‘বার বার হাত বেঁধে দিচ্ছে’— এই অভিযোগ তুলে প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তার পরেই ‘বিতর্ক’! সিঙ্গল বেঞ্চে চ্যালেঞ্জ হওয়া রায়কে ফিরিয়ে দেয় হাই কোর্টের চারটি ডিভিশন বেঞ্চ।
এ সব দেখেশুনে এক আইনজীবী বললেন, ‘‘বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় খুবই কড়া মেজাজের লোক। কথায় কথায় তিরস্কার করেন। তার ফলে খবরের শিরোনামে এসে জনপ্রিয় হচ্ছেন।’’ আর এক আইনজীবীর কথায়, ‘‘ও সব বাদ দিন! মোদ্দা কথা, উনি চোর ধরছেন! তবে শুধু ‘প্রশংসা’ নয়, ‘সমালোচনা’ এবং ‘বিতর্ক’ও তৈরি হয়েছে তাঁকে ঘিরে। তাঁর এজলাস বয়কট বা সংশ্লিষ্ট মামলা থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জল্পনাও তৈরি হয়েছে! সব মিলিয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে আলোচনার কেন্দ্রে রেখে যাবতীয় যুক্তি, পাল্টা যুক্তিতে সরগরম হাই কোর্ট পাড়া।
এর আগে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আইনজীবীদের বলেছিলেন, এমন সব অনিয়ম দেখার পরেও কোনও বিচারপতিই এই চেয়ারে বসে চুপ থাকতে পারে না! তাঁর পক্ষেও সম্ভব নয়। বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘এই সব মামলায় ঘুমানোর আগে আদালতকে অনেক মাইল যেতে হবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy