Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

তৃণগাছিটিও জল পায় তর্পণের মন্ত্রে

শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে গঙ্গামাটি ঘিরে গঙ্গাজল ঢেলে তৈরি হয় তর্পণস্থল।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:৫৬
Share: Save:

আবক্ষ গঙ্গায় ভিজে হাতে চিলতে কাগজ সামলাতে নাজেহাল! ওই কাগজ ছাড়া, পিতৃকুল, মাতৃকুলের বিগত তিন প্রজন্মকে পাঠানো অর্ঘ্য পৌঁছবে না। কোষাকুষির জল ঢালতে গিয়ে সেই কাগজে লেখা পূর্বপুরুষের নামটাই ধেবড়ে গেল। পিতৃপক্ষের শেষ দিন, মহালয়ার সকালে এমন বিপত্তি আকছার ঘটে। বাবা বা ঠাকুরদার আগের প্রজন্মের নাম মনে করতে ঢোঁক গেলেন গড়পড়তা বংশধর। তর্পণে কাছের জনকে জল দিয়ে তৃপ্ত করার আকুতি তবু আবহমান। মন্ত্রের তাৎপর্য অনুভব করলে কিন্তু এই আচার নিছকই নিজের পরিবারের গন্ডিতে আটকে বলে মনে হবে না।

‘‘গীতা বলছে, জগতের মাঝে নিজেকে বা নিজের মধ্যে জগৎকে দেখতে পারাটাই হল, ধর্মের মোক্ষ। এই অনুভব ছুঁতে পারলেই কারও পক্ষে অপ্রিয় কিছু করা অসম্ভব,’’ বলছিলেন পুরাণ-শাস্ত্রবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। তর্পণের মন্ত্র ধর্মের এই গভীর নির্যাস তুলে ধরে বলে মত তাঁর। ‘লক্ষ্মণ তর্পণ’-এর মন্ত্র এক নিঃশ্বাসে সবাইকে স্মরণ করে বলছে, ‘আব্রহ্ম স্তম্বপর্য্যন্তং জগত্তৃপ্যতু’! নৃসিংহবাবুর কথায়, ‘‘স্তম্ব মানে তৃণগাছি। মানে ব্রহ্মা থেকে তৃণগাছি পর্যন্ত সবাইকে জল দেওয়া হয়ে গেল এক মন্ত্রেই।’’ ধর্মের এই বোধ আপন ও বাহিরকে মেলায়। পশুমানুষ, আত্মীয়-অনাত্মীয়, জাত-বেজাত ফারাক দেখে না। প্রাবন্ধিক চৈতন্যময় নন্দের চোখেও, ‘‘এর থেকে বড় বিশ্বমানবতার অনুভব আর নেই।’’

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে, তোমার ওই বাদল বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে’! তর্পণের মন্ত্রেও সবার কথাই বলা হয়। ‘‘চাইলে অনাত্মীয় বা সন্তানহীন কোনও প্রিয়জনকেও স্মরণ করা যায়।’’— বলছেন প্রবীণ পুরোহিত শম্ভুনাথ ভট্টাচার্য স্মৃতিতীর্থ। বিগত জন্মের বা কোটি-কোটি বছর পিছনের চেনা-জানা— সবার স্মরণেই মন্ত্র রয়েছে। শেক্সপিয়রের ‘নামে কি বা আসে যায়’-এর তত্ত্বও তর্পণের বেলায় খাটে। নাম-গোত্র জানা না-থাকলে বা মনে না-পড়লে ‘যথা নাম’ বলে মন্ত্রোচ্চারণের রীতি শোনা যায়।

শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে গঙ্গামাটি ঘিরে গঙ্গাজল ঢেলে তৈরি হয় তর্পণস্থল। প্রবীণ গৃহকর্তা অলককৃষ্ণ দেব বলেন, ‘‘মা গঙ্গাই আমাদের বাড়ি আসেন, বলতে পারো!’’ সেখানে পিতৃকুল, মাতৃকুল এবং মা, ঠাকুরমা, ঠাকুরমার শাশুড়ি ইত্যাদি পূর্বনারীদের স্মরণের রেওয়াজ। তবু স্মরণের আচারে পূর্বনারীরা খানিক কাব্যে উপেক্ষিত মনে হয়। ‘‘মেয়েদের তর্পণে বাধা নেই। আজকাল অনেকেই গঙ্গার ঘাটে যাচ্ছেন,’’ বলেন বৈদিক পণ্ডিত ও পুরোহিত মহামিলন কেন্দ্রের সভাপতি নিতাই চক্রবর্তী। ইদানীং তর্ক ঘনায়, মৃতজন স্মরণে বিধুর পিতৃপক্ষের শেষ দিনটিতে ‘শুভ মহালয়া’ বলা কি ঠিক? পণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞেরা আপত্তির কিছু দেখছেন না। গোটা পিতৃপক্ষ জুড়েই পূর্বজদের স্মরণ বিধেয়। তাঁরা যে-দিন জল নিতে আসেন, স্মৃতিভারে আতুর হলেও সেই দিন ‘শুভ’ হবে না কেন!

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2019 Tarpan Religion Ritual
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy