এমন বাড়িগুলির ভারসাম্য নির্ভর করে তার দেওয়াল বেয়ে নীচে নামা, ভিতের নীচে লুকিয়ে থাকা মাটির শক্তি ও স্থায়ীত্বের উপরে। যদি কোনও কারণে ভিটের তলার মাটি সরতে থাকে, বাড়ির কাঠামোর বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেয়।
আবারও পুরনো আতঙ্ক। আবারও কলকাতার নতুন ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প। রাত-দুপুরে বাড়িতে ফাটলের আতঙ্কে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটতে থাকা মানুষ, নিজেদের ভিটে-মাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এই সেই পুরনো বৌবাজার, যেখানে তিন বছর আগে মেট্রো রেলের সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময়ে বাড়ি ভাঙার আতঙ্কে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বৌবাজার এলাকার দুর্গা পিতুরি লেনের এই বাড়িগুলি শতাব্দী প্রাচীন, জরাজীর্ণ এবং ইট-চুন-সুরকির ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেটা অনস্বীকার্য। কার্যত, এমন বাড়ির দেওয়াল সেই বাড়ির কাঠামোর ভারবাহী অংশ হিসেবে কাজ করে। এমন বাড়িগুলির ভারসাম্য নির্ভর করে তার দেওয়াল বেয়ে নীচে নামা, ভিতের নীচে লুকিয়ে থাকা মাটির শক্তি ও স্থায়ীত্বের উপরে। যদি কোনও কারণে ভিটের তলার মাটি সরতে থাকে, বাড়ির কাঠামোর বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেয়। এমন মাটি সরার ঘটনা ভূমিকম্প থেকে শুরু করে বিস্ফোরণ, নির্মাণ যন্ত্রের কাঁপুনি, মাটির মধ্যে জলের চোরাস্রোত-সহ বহু কারণেই ঘটতে পারে।
এমনিতেই বয়সের ভারে দুর্বল বাড়িগুলিতে এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত ফাটল বাড়তে পারে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বাড়ি ভেঙেও পড়তে পারে। ফলে বৌবাজারের মতো এলাকায়, যেখানে বাড়ির ঘনত্ব এবং জনঘনত্ব উভয়ই তুলনায় বেশি, সেখানে যে কোনও ধরনের নির্মাণ প্রকল্প চলাকালীন বাড়তি সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি।
আর এই প্রেক্ষিতেই সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন, এই প্রকল্প এলাকা সংলগ্ন বাড়িঘরের স্থায়িত্ব নিয়ে মেট্রো নির্মাণকারী সংস্থা কিংবা মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ কতটা সতর্ক ছিল? কারণ, মাটির অনেকটা নীচে নির্মাণ হলেও তার প্রভাব নির্মাণ ক্ষেত্রের বাঁয়ে-ডাইনে, উপরে-নীচে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে নির্মাণ ক্ষেত্রের লাগোয়া অঞ্চলে যদি দুর্বল কাঠামোর বাড়ি-ঘর থাকে, সে ক্ষেত্রে সেগুলির স্থায়িত্ব বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি থাকবেই। ফলে এমন ঝুঁকি নিরসনে নির্মাণকারী সংস্থার ঝুলিতে কী কী প্রযুক্তি-নির্ভর ভাবনা লুকিয়ে ছিল, জানা নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সেই ফাটল-আতঙ্কের পুনরাবৃত্তি।
২০১৯ সালে টানেল বোরিং মেশিন চালু থাকাকালীন সেই অঞ্চলের মাটি ধসে জলের তোড়ে টানেলের মধ্যে মাটি গোলা জল কয়েক দিন ধরে বয়ে গিয়েছিল। ফলে সন্নিহিত অঞ্চলের বাড়িগুলির ভিতের তলার মাটিও দ্রুত সরে গিয়ে বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল তৈরি হয়েছিল। এ বার কিন্তু টানেল বোরিং মেশিনের কাজ শেষ হওয়ার পরে এমন ফাটল বিপর্যয় ঘটল। এ ক্ষেত্রে বোরিং মেশিনের কাজ শেষ হয়ে গেলেও সুড়ঙ্গ নির্মাণ এবং নতুন সুড়ঙ্গ পথের সঙ্গে পুরনো সুড়ঙ্গের সংযোগের কাজ চলছিল। এই সময়ে নির্মাণক্ষেত্রে যে বিশেষ সতর্কতাগ্রহণ কাঙ্ক্ষিত ছিল, সেটা গ্রহণ করা হয়েছিল কি না, এই বিপর্যয়ের চরিত্র দেখে সেই প্রশ্ন উঠছে। ইতিমধ্যে মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, পুরনো টানেলে জল ঢোকার বেশ কিছু ছিদ্রপথ বন্ধ করা গেলেও, কিছু ছিদ্রপথ এখনও বহাল রয়েছে। ফলে তেমন ছিদ্রপথ গলে আবারও কাদামাটির জল ঢুকে পড়েছে সুড়ঙ্গের মধ্যে। ফলে সেই সব বাড়ির ভিতের তলায় আবারও ভূমিক্ষয় ঘটছে। ফের সেই ফাটল ফিরে এসেছে।
গত বার বিপর্যয়ের পরে সেই অঞ্চলের বাড়িগুলির ফাটল মেরামত করে সেগুলিকে নিরাপদ এবং বাসযোগ্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু বাড়ির নিরাপত্তা, বাড়ির উপরি কাঠামোর ফাটল মেরামতের ওপর নির্ভর করে না। বাড়ির ভিতের তলার মাটির শক্তিক্ষয় হলেও বাড়ির নিরাপত্তা একই ভাবে বিঘ্নিত হয়, যার জলজ্যান্ত উদাহরণ হল বৌবাজারের এই ফাটল বিপর্যয়। এখানেও প্রশ্ন, বিগত দুর্ঘটনার পরে সেই এলাকার দুর্বল বাড়িগুলির ভিত সংলগ্ন মাটির শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘গ্রাউটিং’ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু সেই ‘গ্রাউটিং’-এর পরে মাটির শক্তিবৃদ্ধি যদি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়েই থাকবে, তা হলে কেন এখন ভিতের তলার মাটি সরার ঘটনা ঘটছে?
ফলে আবারও পুরানো প্রবাদটি মনে পড়ছে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। আর এমন স্পর্শকাতর প্রকল্পে পুরসভা কিংবা রাজ্য সরকারকেও আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। সুড়ঙ্গ মাটির বহু নীচে কাটা হলেও, মাটির উপরে থাকা মানুষের সুরক্ষা যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করেই এমন প্রকল্পের ছাড়পত্র দিতে হবে।
লেখক: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy