প্রতীকী চিত্র
যদি প্রশ্ন করা হয়, ভারতের কৃষিতে মূল চ্যালেঞ্জ কী? সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন, চাষিদের ফসলের ন্যায্য দাম না-পাওয়া। কেন্দ্র এ সত্য অস্বীকার করতে পারেনি বলেই এক সময় এমএস স্বামীনাথনের নেতৃত্বে কৃষক কমিশন তৈরি করেছিল। কমিশন সুপারিশে বলেছিল, ফসল উৎপাদনের মোট ব্যয়ের দেড় গুণ অন্তত তার বিক্রয়মূল্য হওয়া প্রয়োজন। ব্যাঙ্ক থেকে প্রয়োজনমতো তাঁদের ঋণ পাওয়া প্রয়োজন। আর কৃষি বিপণনে যথাযথ নজর দেওয়াও প্রয়োজন।
নতুন কৃষি বিল নিয়ে দেশ এখন উত্তাল। এই বিলের মাধ্যমে কৃষি পণ্য উৎপাদন, মজুত এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। অধ্যাদেশগুলিতে বলা হয়েছে, ‘এক দেশ, এক কৃষি’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। নিয়ন্ত্রিত বাজারের বাইরে কৃষকদের ফসল বিক্রির স্বাধীনতা অর্জিত হবে। আন্তঃরাজ্য ফসল প্রেরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হবে। নতুন ব্যবস্থায় দাদন দিয়ে ফরমায়েশি চাষ আইনসিদ্ধ হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকারী, পাইকারি ও খুচরো শস্য ব্যবসায়ী ও রফতানিকারীদের সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত মূল্যে কৃষকের চুক্তি করার স্বাধীনতা থাকবে। নতুন বিলে বদলে দেওয়া হল অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেলের মতো খাদ্যদ্রব্য অবাধ মজুত আইনসিদ্ধ হলে দেশি ও বহুজাতিক লগ্নিকারীরা আকৃষ্ট হবে। তাতে চাষিদের লাভ কোথায়?
আমাদের অভিজ্ঞতা কী বলে?
এ দেশের চাষিদের সিংহভাগ চাষবাসের জন্য মহাজনি ঋণের ভরসায় থাকেন। নতুন কৃষি আইন ফসলের ন্যূনতম দাম নির্ধারণে কোনও পদক্ষেপ না করে তা বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এটা বিপজ্জনক। বাজার কিন্তু কখনওই ‘ফেয়ার প্লে ফিল্ড’ নয়। দরিদ্র কৃষকেরা এ বাজারে যোঝার ক্ষমতা কী করে পাবেন?
চুক্তি চাষের মাধ্যমে অতি উর্বর জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের বদলে ফরমায়েশি ফসলের চাষ স্বাভাবিক ভাবেই বাড়বে। আর খাদ্য উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ হবে অপেক্ষাকৃত অনুর্বর জমি। ফলে, খাদ্য উৎপাদনের হার কমার আশঙ্কা থাকছেই। সঙ্কটের দরুণ ‘হোর্ডিং’ এবং ‘ফরওয়ার্ড ট্রেডিং’-এর ফলে বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বে। যেমনটা মাঝেমধ্যেই পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমরা দেখে থাকি।আন্তঃরাজ্য ফসল প্রেরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আদৌ ছিল নাকি?
মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ আমাদের রাজ্যে আসে না? আসলে যেটা সরকার অনুচ্চারিত রেখে করতে চাইছে, তা হল, প্রয়োজনে কৃষকের কাছ থেকে ‘মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস’ (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য) দিয়ে ফসল কেনার দায়িত্বও আর সরকারের থাকবে না। সবটাই কর্পোরেটরা নিয়ন্ত্রণ করবে।ইচ্ছেমতো শুধু মুনাফার জন্য আপনার রাজ্যের ফসল অন্যত্র চালান হবে। আপনার বাজারে সে ফসলের জোগান কমলেও সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ থাকবে না। দেদার ‘ফরওয়ার্ড ট্রেডিং’ হবে। আর তার মুনাফা ঢুকবে চাষির নয়, বড় কর্পোরেটদের পকেটে। আমপানের সময়ে বাজারে সঙ্কটের কথা মনে করুন। সরকারের হস্তক্ষেপে কলকাতার বাজারে জেলা, মফস্সল আনাজের জোগান দিয়ে মানুষকে রক্ষা করেছিল। তা কিন্তু আর হবে না। কর্পোরেট দাপটে তা উৎপাটিত হবে।
যেটা ঘটতে যাচ্ছে, তা হল, স্বল্প সুদে কৃষকের চাষবাসের খরচ সামলানোর জন্য অর্থের জোগান দিতে ব্যাঙ্কঋণের প্রশ্ন আর থাকবে না। দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হলে তার দায়ও কৃষককেই সামাল দিতে হবে। কৃষক-বিমার তামাশায় সর্বক্ষেত্রে কৃষকের নয়, বিমা সংস্থাগুলিরই স্বার্থ রক্ষিত হয়। ফলে, সরকার সাহায্য নিয়ে পাশে না দাঁড়ালে মূলত বিপদ বাড়বে কৃষকের।
বড় কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে দরদাম স্থির করা বা ফসল নির্বাচনের কোনও মাপকাঠি না থাকলে অনিয়ন্ত্রিত বাজারে চাষিদের স্বাধীনতা খর্ব হবে না তো? তা না হলে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনে কৃষকের যে ভূমিকা, কর্পোরেট-দাপটে তা উৎপাটিত হবে। অতীতে বাংলার নীলচাষের অভিজ্ঞতা বা ‘সবুজ বিপ্লব’ পরবর্তী অভিজ্ঞতা কিন্তু সে বিপদের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
(মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy