Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Dhaniakhali

গ্রাম কেশবপুর, জঙ্গি আয়েশা ওরফে প্রজ্ঞার খোঁজে এবিপি ডিজিটাল

বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, আয়েশা জন্নত মোহনা নামে ওই জঙ্গি নেত্রী আদতে পশ্চিমবঙ্গের হুগলির বাসিন্দা। আসল নাম প্রজ্ঞা দেবনাথ।

এই ঘরেই থাকত প্রজ্ঞা ওরফে আয়েশা (ইনসেটে)। —নিজস্ব চিত্র 

এই ঘরেই থাকত প্রজ্ঞা ওরফে আয়েশা (ইনসেটে)। —নিজস্ব চিত্র 

সিজার মণ্ডল
ধনিয়াখালি (হুগলি) শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২০ ২১:২৭
Share: Save:

পলেস্তারা খসে যাওয়া ইট বের করা একতলা বাড়ি। রাস্তা থেকে ঢোকার মুখেই টিউবওয়েল। সেটাকে বাঁ দিকে রেখে, মুখের উপর ঝুলে পড়া পেয়ারা-আম গাছের ডাল সরিয়ে এগোলে চোখে পড়ে বাড়ির দেওয়াল। একতলা বাড়ির সামনের অ্যাসবেসটসে ঢাকা বারান্দা ইট দিয়ে ঘেরা।

এটাই প্রজ্ঞা দেবনাথের বাড়ি। নাহ, ‘জঙ্গি’ আয়েশার বাড়ি। হরিপাল থেকে ধনিয়াখালির দিকে যে পাকা রাস্তাটা গিয়েছে, সেই রাস্তা থেকে মেরেকেটে ১০০ মিটার দূরে। বাড়ির সামনে ফাঁকা জমিতে অযত্নে বেড়ে ওঠা প্রায় হাঁটু সমান ঘাস আর আগাছা পাশ কাটিয়ে দরজায় পৌঁছতে পৌঁছতেই মনে পড়ল রাস্তার সেই যুবকের কথা।

বাংলাদেশ পুলিশের দাবি অনুযায়ী, আইএস মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠন নব্য জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-র মহিলা শাখার প্রথম সারির নেত্রী আয়েশা জন্নত মোহনা ওরফে প্রজ্ঞা দেবনাথের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ধনিয়াখালির কেশবপুর গ্রাম। পথে সেই গ্রামের হদিশ পেতে দাঁড়িয়েছিলাম ভান্ডারহাটি মোড়ে। গ্রামের নাম বলতেই এগিয়ে আসা যুবক এক ঝলক গাড়ির সামনে থাকা ‘প্রেস স্টিকার’-এর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন — ‘‘জঙ্গি প্রজ্ঞার বাড়ি যাবেন?’’ কোনও উত্তরের অপেক্ষা না করেই সেই যুবক সামনে আঙুল তুলে বলেন,‘‘সোজা চলে যান এক কিলোমিটার। বাঁ দিকে কেশবপুর কালীবাড়ি। তার উল্টো দিকে টাইম কলের পাশ দিয়ে ঢালাই রাস্তা। ওখানেই বাড়ি।”

বাড়িতে দৈন্যের ছাপ স্পষ্ট। —নিজস্ব চিত্র

সেই আঁকা বাঁকা ঢালাই রাস্তা চলে গিয়েছে গ্রামের বাঁশ ঝাড় পাশ কাটিয়ে। একটু এগিয়ে চোখে পড়ল রাস্তার পাশে বাঁধা ছাগলের দড়ির খুঁটি তুলছেন এক প্রৌঢ়। তাঁকে প্রজ্ঞার বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করতেই আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন। কোনও প্রশ্ন করার আগেই যে ভাবে শশব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন তাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত — ‘এ প্রসঙ্গে কথা বলতে চান না’।

আরও পড়ুন: হুগলির প্রজ্ঞাই ঢাকার জেএমবি জঙ্গি মোহনা!

দু’কামরার বাড়ির সামনের ঘেরা বারান্দায় লোহার দরজা। প্রজ্ঞার মা গীতা দেবনাথের খোঁজ করতেই বেরিয়ে এলেন বছর ২৪-এর এক যুবক। পরিচয় দিতেই বলে ওঠেন,‘‘সবই তো পুলিশকে বলেছি। আবার কি?” বেশ কয়েক মিনিট অনুরোধের পর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ়া। রঙ জ্বলা সবুজ শাড়ি পরনে। বারান্দার ডান পাশে বড় পাখির খাঁচা থেকে আসা অনেকগুলো পাখির তীব্র ডাকাডাকি ছাপিয়ে খুব স্পষ্ট কাটা কাটা উচ্চারণে প্রৌঢ়া বলে উঠলেন,‘‘ বলুন। আমিই প্রজ্ঞার মা।” কপালের উপর সিঁথির দুপাশে সাদা চুলের রাশি, তার মধ্যে হালকা সিঁদুরের ছোপ। হাতে শাখা আর চুড়ি। তাতে যে সোনার প্রলেপ আদৌ কতটা আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও অবান্তর। তিনিই ডেকে নিলেন ভিতরের বারান্দায়। একটা রঙচটা প্লাস্টিকের চেয়ার। মেঝেতে রাখা একটা কাঠের পিড়ি টেনে ইঙ্গিত করলেন চেয়ারে বসার। ইতস্তত করতে দেখে মুখোমুখি এগিয়ে দিলেন আরেকটা কাঠের পিড়ি। মহিলার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। আসবাবহীন বারান্দায় ছড়িয়ে আছে গৃহস্থালীর টুকিটাকি জিনিস পত্র। এক কোণে ধুলো মাখা দু’টি সাইকেল। তার মধ্যে একটা নীল রঙের লেডিজ সাইকেল। সব কিছুর মধ্যে বারান্দার মাঝখানে বেমানান বেখাপ্পা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা চকচকে লাল রঙের মোটরবাইক।

অস্বস্তিকর নৈশব্দ ভেঙে প্রজ্ঞার মা গীতাই বলে উঠলেন,‘‘ কি জানতে চান বলুন?” গুমোট পরিবেশটা একটু স্বাভাবিক করতেই আলগোছে ছোট্ট প্রশ্ন করলাম,‘‘ মেয়ের সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছিল?” প্রথমেই এই প্রশ্নটা বোধহয় প্রত্যাশা করেননি প্রৌঢ়া। কয়েক সেকেন্ডের আড়ষ্টতা কাটিয়ে উত্তর দিতে গিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বলেন,‘‘এই তো সেদিনও আমাকে লিখল প্রচণ্ড ঠান্ডা লেগেছে। সর্দি-জ্বর। খুব কষ্ট পাচ্ছে।” কথাটা বলেই হঠাৎ থমকে গেলেন গীতা। চোখে মুখে একটা শঙ্কা, না বলার মতো কোনও কথা বেফাঁস বলে ফেলার মতো অবস্থা।

প্রৌঢ়ার কথার মাঝেই চোখ চলে যায় বারান্দার পাশের দুটো ঘরের দিকে। আলাদা করে চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। সাদামাটা প্রায় আসবাবহীন দু’টি ঘরেই তক্তপোষ পাতা। একটা ঘরে বিছানায় শুয়ে এক প্রৌঢ়। প্রশ্ন করার আগেই গীতা বলেন,‘‘ আমার স্বামী।’’ পাশের ঘরের বিছানায় বসে সেই যুবক যাঁকে প্রথমে দেখেছিলাম। বলে না দিলেও বুঝলাম এই যুবকই প্রজ্ঞার ভাই অভিজিৎ।

আরও পড়ুন: সংস্কৃত পড়তে পড়তে উধাও... প্রজ্ঞা থেকে নব্য জেএমবি-নেত্রী আয়েশা!

গীতা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে অভিজিৎ বলে ওঠেন,‘‘যা সত্যি তাই বলে দাও। লুকোনোর কিছু নেই আর।” তার পর নিজেই বলেন,‘‘দিদির সঙ্গে মায়ের যোগাযোগ নিয়মিত ছিল। গত মাসেও কথা হয়েছে। আমাকেও প্রায়ই হোয়াটস্ অ্যাপ কলে ফোন করত দিদি।” ছেলেকে থামিয়ে চোখের জল মুছে প্রৌঢ়া বলেন,‘‘ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কয়েক মাস পরেই বাংলাদেশ থেকে ফোন করেছিল। বলেছিল সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। তার কয়েক দিন পরেই সটান বাড়িতে হাজির। থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু থাকতে দিতে পারিনি।” প্রজ্ঞা যখন বাড়ি ছাড়ে তখন সে ধনিয়াখালি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সংস্কৃত নিয়ে পড়ছিল।

প্রজ্ঞা ওরফে আয়েশার মা গীতা দেবনাথ। —নিজস্ব চিত্র

গীতার কথায়, ‘‘সমাজ মেনে নিত না। পাড়া প্রতিবেশীরা এক ঘরে করে দিত। সব চেয়ে বড় কথা, ছেলের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ওর বাবা চায়নি মেয়ে ফিরে আসুক।” কয়েক দিন থেকেই প্রজ্ঞা ফিরে গিয়েছিল বাংলাদেশে। যদিও মা ছাড়াও ভাই, দুই পিসির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। রানাঘাটের বাসিন্দা বড় পিসির মেয়েকেও প্রতি বছরের মতো এ বছরের ১৮ জুন জন্মদিনে ফোন করে শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেনি ‘জঙ্গি’ আয়েশা ওরফে প্রজ্ঞা।

যদিও অভিজিতের কথায় অন্য সুর। ক্ষোভের সুরে তিনি বলেন,‘‘দিদি ওই ভাবে চলে যাওয়ার পর আমরা দিদির প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলতাম। যাঁরা জানে না তাঁদের বলতাম দিদির বাইরে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমরা চাইনি দিদি আর ফিরে আসুক।” প্রজ্ঞার থেকে বছর দেড়েকের ছোট অভিজিত। হরিপাল কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে কাজ করতেন একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থায়। লকডাউনে সেই কাজ নেই আর। সেই কথা প্রসঙ্গে বলেন,‘‘তখন করোনা নিয়ে গ্রামে প্রচন্ড আতঙ্ক ছিল। আমি কলকাতায় কাজ করলে এলাকার লোক আমাকে আর বাড়ি ঢুকতে দিত না।”

অভিজিতের ছোট্ট এই মন্তব্য ইঙ্গিত দেয় প্রজ্ঞা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছে, সেই খবর গ্রামে কতটা প্রতিকূলতার সৃষ্টি করেছিল দেবনাথ পরিবারের পক্ষে। একদিকে সেই সমাজ, অন্যদিকে বাড়িতে স্বামী-ছেলের এই ক্ষোভ আগলেই মেয়ের সঙ্গে গীতার যোগাযোগ ছিল অটুট। এমনকি এ বছরের জানুয়ারিতে মেয়ের শরীর খারাপ শুনে অভাবের সংসারে কোনও মতে জমানো সামান্য টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা ছেলেকে দিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন মেয়ের বাংলাদেশের অ্যাকাউন্টে। যদিও সে সবই হয়েছে প্রজ্ঞার বাবা প্রদীপ দেবনাথের অগোচরে। এ দিনও তিনি কোনও ভাবে কথা বলতে রাজি হলেন না মেয়ের বিষয়ে। পাশের ঘরের বিছানা থেকে শুধু বলে উঠলেন,‘‘ ওই মেয়ের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।

আরও পড়ুন: মেয়ের সাজা চান ‘জঙ্গি’ প্রজ্ঞার বাবা-মা

বাংলাদেশ পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখার দাবি, প্রজ্ঞা নব্য জেএমবি-র মহিলা শাখার প্রথম সারির নেত্রী। সে অনলাইনে নতুন সদস্য নিয়োগ করত। দেশে বিদেশে আইএস (ইসলামিক স্টেট) মতাদর্শে বিশ্বাসী লোকজনদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করত। সেই টাকা সংগঠনের কাজে খরচ করত। শুধু তাই নয়, মাদ্রাসায় শিক্ষকতার ফাঁকে নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণও দিত। বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের দাবি, নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০০৯ সালে ইসলামে দীক্ষিত হয় প্রজ্ঞা। অনলাইনে যোগাযোগ হয় জেএমবি-র নেতাদের সঙ্গে। ২০১৯ সালে ওমানে থাকা এক বাংলাদেশি নাগরিককে বিয়েও করে।

সামাজিক প্রতিকূলতা, বাড়িতে স্বামী-ছেলের বিরোধিতা স্বীকার করে নিয়েও, তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমার মেয়ে যদি জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য হবে তা হলে নিয়মিত আমার সঙ্গে বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত কি করে? জঙ্গি হলে ২০১৬ সাল থেকে একই ফোন নম্বর থেকে আমাকে যোগাযোগ করছে কি করে? শুনেছি জঙ্গিরা নিয়মিত ফোন পাল্টায়, সিম পাল্টায়।

এই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে প্রজ্ঞা। —নিজস্ব চিত্র

২০০৯ সালে মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ত। ও যদি সেই সময়ে ইসলামে দীক্ষিত হবে তা হলে তার পর কী ভাবে বাড়ির সমস্ত পুজো বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সক্রিয় ভাবে যোগ দিল? গীতার কথায়, ৩০ এপ্রিল ২০১০ সালে তাঁর শাশুড়ি প্রতিভা মারা যান। ২৪ অগস্ট ২০১৬ সালে মারা যান শ্বশুর দেবেন্দ্রনাথ। তিনি পুলিশ কর্মী ছিলেন। গীতা বলেন,‘‘শ্রাদ্ধের যে আচার সমস্ত কিছুই মেনে চলেছে মেয়ে। এমনকি ২০১৬ সালে প্রজ্ঞা নিজেই আমাদের বাড়ির সামনে কালীমন্দিরে পুজো দিতে যেত। আমি তো শুনেছি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে এ সব কিছু করা যায় না।” পুলিশের কাছে শুনলাম, বাংলাদেশ পুলিশ বলেছে অনলাইনে মেয়ের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু আমার মেয়ের তো স্মার্ট ফোনই ছিল না। বাড়িতে কম্পিউটারও ছিল না। তা হলে কী ভাবে যোগাযোগ হল?

গীতার করা প্রশ্ন উড়িয়ে দিতে পারছেন না জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার গোয়েন্দারাওো। তাঁরা স্বীকার করেন, জেএমবি বা আইএস নিয়ে কোনও তদন্তেই কোনও দিন প্রজ্ঞার নাম উঠে আসেনি। বাংলাদেশ পুলিশ গ্রেফতার করার পরই তাঁরা জেনেছেন। তদন্তকারী সংস্থার এক শীর্ষ আধিকারিক বলেন,‘‘ ওই ধরনের সংগঠনে থেকে এ ভাবে প্রায় প্রকাশ্যে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটা বেশ অস্বাভাবিক। সাধারণত ধর্মীয় আবেগ থেকে এ ধরনের সংগঠনে যোগ দেয় মানুষ। সেক্ষেত্রে প্রজ্ঞার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগের যে ঘটনাক্রম পাওয়া যাচ্ছে তার সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতা মিলছে না।”

পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে বিছানায় শুয়ে থাকা প্রৌঢ়ের ক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর। ছেলে অভিজিতকে কিছু বলছেন প্রজ্ঞার বাবা। তার কয়েক মিনিট পরেই মাকে থামিয়ে দিয়ে অভিজিত পাশের ঘরের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলেন,‘‘ এই ঘরেই থাকত দিদি।” তক্তপোশের পাশে একটা সস্তার লোহার শোকেস। কয়েকটা কৌটো সেই শোকেসের উপর। দেওয়ালে কয়েকটা ব্যাগ ঝুলছে ইতিউতি। প্রজ্ঞার ভাই মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,‘‘তোমার মেয়ে যদি জঙ্গি দলে নাম না লিখিয়ে থাকে তবে যাওয়ার সময়ে সব ছবি পুড়িয়ে দিল কেন? সব সার্টিফিকেট নিয়ে চলে গেল কেন?” অভিজিতের কথার সুরটা অনেকটা তাঁদের এক প্রতিবেশীর মতো। প্রজ্ঞাদের বাড়িতে ঢোকার আগে নাম প্রকাশ করা যাবে না শর্তে এক বৃদ্ধ বলেন,‘‘ এমনিতে তো তেমন কিছু চোখে পড়েনি। তবে খুব ফোনে কথা বলত।” প্রজ্ঞাদের বাড়ির সামনের একটা কালভার্ট দেখিয়ে ওই বৃদ্ধ দাবি করেন, “গভীর রাত অবধি প্রজ্ঞা নাকি হিন্দিতে কথা বলত ফোনে।” ওই বৃদ্ধের সঙ্গী তার মাঝেই গলা নীচু করে মন্তব্য ছুঁড়ে দেন,‘‘দুর্গাপ্রসাদ গ্রামের একটা মেয়ের সঙ্গে তো খুব ভাব ছিল। দিনরাত আসা যাওয়া ছিল। দেখুন ওদের পাল্লায় পড়ে এ সব দলে নাম লিখিয়েছে কি না।” ভান্ডারহাটি ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার গ্রাম কেশবপুর। গোটা অঞ্চলেই মিশ্র জনবসতি। দুর্গাপ্রসাদ সংখ্যালঘু এলাকা হিসাবে পরিচিত। প্রতিবেশী বৃদ্ধের ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। তিনিই মনে করিয়ে দেন, যে বছর প্রজ্ঞা বাড়ি ছেড়েছিল, সেই বছরটি কেশবপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে দশঘড়া গ্রাম থেকে আইএস যোগে গ্রেফতার হয়েছিল আশিক আহমেদ নামে এক যুবক। চলে যেতে যেতে ওই বৃদ্ধ খুব সন্তর্পণে ছুঁড়ে দেন তাঁর মতামত,‘‘দেখুন ওই ঘটনার সঙ্গে এ বাড়ির মেয়েরও যোগ থাকতে পারে।”

এই কালভার্টে বসেই হিন্দিতে ফোনে কথা বলত প্রজ্ঞা, দাবি প্রতিবেশীদের। —নিজস্ব চিত্র

প্রতিবেশীদের এ ধরনের মন্তব্যের গীতা শুনেছেন অনেক বার। দুর্গাপ্রসাদের বাসিন্দা প্রজ্ঞার বান্ধবীর কথা উঠতেই তিনি স্বীকার করেন,‘‘ ওই মেয়েটি ছিল প্রজ্ঞার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। ক্লাস ফাইভ থেকে কলেজ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছে ওরা। মেয়ে প্রায় প্রতিদিনই অনেকটা সময় কাটাতো ওদের বাড়িতে।” তবে সেই সঙ্গে বান্ধবী প্রসঙ্গে ক্ষোভও উগরে দেন। জানান, প্রজ্ঞা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর খোঁজ করতে গেলে ওই বান্ধবী বা তার বাড়ির লোকজন কোনও রকম সহযোগিতা করেননি। এ দিন দুর্গাপ্রসাদে গেলেও প্রজ্ঞা নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি ওই বান্ধবীর পরিবার। শুধু জানিয়েছেন, প্রজ্ঞা বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই তাঁদের মেয়ের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না প্রজ্ঞার। স্থানীয় বাসিন্দদের কয়েকজনের কাছ থেকে জানা যায়, প্রজ্ঞা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিয়ে হয়েছিল সেই বান্ধবীর। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বাবার কাছেই থাকে প্রজ্ঞার সেই সহপাঠী।

গীতা জানেন প্রতিবেশীদের মন্তব্যের কথা। তিনি এও জানেন,প্রজ্ঞা বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর গোটা এলাকায় তৈরি হওয়া আলোড়ন থিতিয়ে গেলেও, ফের তা বুদবুদের মতো ফুলে ফেঁপে উঠছে, মেয়ে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে। কিন্তু তার পরও গীতা এখনও বিশ্বাস করতে পারেন না এ সব কথা। অস্ফুটে তিনি বলে ওঠেন, ‘‘আমার ক্ষমতা নেই মেয়ের জন্য লড়াই করার।” ছেলেকে এড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলেন,‘‘ যে মেয়ে শরীর খারাপ হলে আমাকে ফোন করত, সেই মেয়ে জঙ্গি হতে পারে আমি এখনও বিশ্বাস করি না।”

অন্য বিষয়গুলি:

Pragya Debnath JMB Terrorist Dhaniakhali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy