(বাঁ দিকে) কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার দৃশ্য। আহত মালগাড়ির সহ-চালক (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র।
ড্রাইভার সাহাব ক্যায়সে হ্যায়? (চালক কেমন আছেন?) হাসপাতালে জ্ঞান ফিরতেই প্রথম এই প্রশ্নটিই করেছিলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় ‘ঘাতক’ মালগাড়ির সহ-চালক মনু কুমার। কিন্তু যখন তাঁকে জানানো হয় চালক অনিল কুমারের মৃত্যু হয়েছে, একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলেন। তার পর আবার চোখ খুলে যন্ত্রণাকাতর মুখে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে, স্ত্রীকে যেন এই দুর্ঘটনার কথা না জানানো হয়। তার পর আবার জ্ঞান হারান মনু।
সোমবার ফাঁসিদেওয়ায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। রাঙাপানি স্টেশন ছাড়ার কিছু ক্ষণ পরেই ট্রেনটিকে পিছন থেকে ধাক্কা মারে একটি মালগাড়ি। যার ফলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনের দিকে একাধিক কামরা লাইনচ্যুত হয়। একটি কামরা উঠে যায় মালগাড়ির উপর। এই সংঘর্ষে মালগাড়িও লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের রয়েছেন মালগাড়ির চালকও। ঘটনার পর পরই রেল এই দুর্ঘটনার দায় ওই চালকের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে! সাংবাদিক সম্মেলন করে রেলবোর্ডের চেয়ারপার্সন জয়া বর্মা দাবি করেছেন, সিগন্যাল না মেনে ট্রেন নিয়ে এগিয়ে যান মালগাড়ির চালক।
দুর্ঘটনার পরে মালগাড়ির সহ-চালক মনুকে উদ্ধার করে প্রথমে শিলিগুড়ি রেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তড়িঘড়ি শিলিগুড়ির এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এখন কেমন আছেন মনু? হাসপাতাল সূত্রে খবর, মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়েছেন মনু। আপাতত তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। তবে দুর্ঘটনার ঘোর এখনও কাটেনি মনুর। তাঁকে কোনও কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে অনেক ক্ষণ বাদে সেই কথার জবাব দিচ্ছেন তিনি। মাঝেমাঝেই জ্ঞানও হারিয়ে ফেলছেন।
বিহারের সহরসা জেলার বাসিন্দা মনু। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলে মনু গত আট বছর ধরে কাজ করছেন রেলে। তাঁর সহকর্মীদের কথায়, ‘‘ওই মালগাড়ির চালকের সঙ্গে কর্মসূত্রেই মনুর পরিচয়। একসঙ্গে কাজ করতে করতে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে এমন দুর্ঘটনা এবং বন্ধুর মৃত্যু তাড়া করে বেড়াচ্ছে মনুকে।’’ বিহারের বাসিন্দা হলেও কর্মসূত্রে স্ত্রীকে নিয়ে শিলিগুড়ির ভক্তিনগর এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন মনু। সোমবারের দুর্ঘটনার খবর সহরসা গ্রামে পৌঁছতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে মনুর পরিবার। সময় নষ্ট না করে শিলিগুড়ি ছুটে আসেন মনুর বাবা। একদমই সাদামাঠা গোছের মানুষ। শহরের চাকচিক্য থেকে বহুদূরে। পরনে ঢিলেঢালা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুত্রকে দেখতে শিলিগুড়ির বেসরকারি হাসপাতালে আসেন তিনি। বছর সত্তরের ওই বৃদ্ধের চোখেমুখে আতঙ্ক আর উদ্বেগের ছাপ ছিল স্পষ্ট। পুত্র ঠিক আছে তো? হাসপাতালে এসেও পুত্রকে দেখতে যেতে সাহস পারছিলেন না বৃদ্ধ। তাই শেষমেশ মনুর সহকর্মীদের কাছ থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলেন। ছলছল চোখে বৃদ্ধ বার বারই এক কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন, “আমার ছেলেটা ভাল আছে তো?” মনুর সহকর্মীরাই আশ্বস্ত করলেন বৃদ্ধকে। তাঁরা জানান, মনু সুস্থ আছেন। পুত্রের সুস্থতার খবর পেয়ে একটু আশ্বস্ত হয়ে রওনা দেন শিলিগুড়িতে মনুর ভাড়াবাড়ির উদ্দেশে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা কী ভাবে ঘটেছিল, দায় কার, এই সব প্রশ্নই উঠছে। প্রকাশ্যে আসছে বিভিন্ন নথি-তত্ত্ব। অনেকের মতে, দুর্ঘটনার সময় ঠিক কী ঘটেছিল, তার আসল কারণ জানা যেতে পারে ওই মালগাড়ির সহ-চালকের থেকেই। হাসপাতালে শুয়ে থাকা মনুও হয়তো বুঝতে পেরেছেন, তাঁর বয়ান কতটা মূল্যবান! বুধবার থেকে রেল কমিশন ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। একাধিক ব্যক্তির বয়ান রেকর্ড করা হবে বলে জানা গিয়েছে। তদন্তে উঠে আসবে আরও অনেক প্রশ্ন। কোন ট্রেনের গতি কত ছিল? কোন কোন সিগন্যাল পার করেছিল? এই সব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে শুধু মনুর কাছেই। তবে আপাতত তিনি চিকিৎসাধীন। তবে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগছে, কমিশন অফ রেলওয়ে সেফটির দস্তাবেজের কাছে মনুর কথা কতটা কার্যকরী হবে? যদিও রেল প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ তদন্তের কথা বলে আসছে।
মঙ্গলবারই অসুস্থ মনুর খোঁজ খবর নিতে মালিগাঁও থেকে এসে উপস্থিত হন উত্তর-পূর্ব সীমান্ত (এনএফ) রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের সদস্যেরা। এনএফ রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের সম্পাদক তথা অবসরপ্রাপ্ত রেলের চালক আশিস বিশ্বাস তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এটা মানতে নারাজ, এই ঘটনা শুধুমাত্র চালকের গাফিলতির ফল। তিনি বলেন, ‘‘চালকের সংখ্যা এতটাই কম যে, তাঁরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম পান না। রেলওয়ে সেফটি কমিটির পর্যালোচনা বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, টানা দু’রাতের বেশি কোন চালক ডিউটি করবেন না। দু’দিন নাইট ডিউটির পর এক দিন তাঁকে বিশ্রাম দিতে হবে। সেখানে মালগাড়ির ওই চালক টানা তিন দিন নাইট ডিউটি করেছিলেন। তার পর পরের দিন তাঁকে ভোরে ফোন করে ডিউটির কথা বলা হয়েছিল ৷ এটাই একটা বড় সমস্যা।’’
পাশাপাশি প্রশিক্ষণের অভাবের কথাও তুলে ধরেছেন আশিস। তিনি বলেন, ‘‘স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর চালকদেরকে যে ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত, সেটা হয় না। একই পরিস্থিতি সিগন্যাল দফতরেও। সেখানেও কর্মী কম। কাজেই সিগন্যালের কারণে ট্রেন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটলে তাঁদের উপর চাপ আসতে থাকে। আর তখনই তাঁরা শটকার্ট পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। ফলে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। যদিও সবটাই তদন্তসাপেক্ষ কিন্তু এটাও সত্যি।’’ আশিসের কথায়, ‘‘সোমবার কোশন অর্ডারে ট্রেন চলছিল। কিন্তু দুর্ঘটনায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের উপর যা প্রভাব পড়েছে, তাতে ট্রেন যদি ঘণ্টায় ১৫ কিলোমিটার গতিবেগে চলে তা হলে এই অবস্থা হওয়ার কথা নয়। এক জনের কাঁধে দোষ না চাপিয়ে সবটা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে দেখা উচিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy