রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস এবং শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। —ফাইল চিত্র।
বোস বনাম বোস লড়াই লেগেই রয়েছে। এক দিকে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস এবং অন্য দিকে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু (বোস)। সেই লড়াই নতুন মাত্রা পেল সোমবার। নানা অভিধায় রাজ্যপাল বোসকে সম্বোধন করলেন শিক্ষামন্ত্রী বোস।
অনেকে বলছেন, কাজের সূত্রেই নরম-গরম সম্পর্ক থাকার কথা দু’জনের। একসঙ্গে কাজ করলে মতের অমিল হতেই পারে বলেও অনেকের ধারণা। তবে ইদানীং ভারসাম্য কিঞ্চিত বিঘ্নিত। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য তথা রাজ্যপালের সঙ্গে এখন শিক্ষামন্ত্রীর সম্পর্কে নরম ভাব কম, গরম ভাবই বেশি। সোমবার সেই গরমের আঁচ মিলল শিক্ষামন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকেও। রাজ্যপালের কাজকর্মকে কটাক্ষ করতে বারে বারে শিক্ষামন্ত্রীর মুখে চলে এল বাছাই করা সব উপমা। তার জেরে কখনও রাজ্যপাল বোস হয়ে গেলেন ব্রিটেনের কাহিনি চরিত্র জেমস বন্ড, আবার কখনও হলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভার সেরা বিদূষক (গোপাল ভাঁড়)! ব্রাত্যের উষ্মা এবং উপমা সেখানেই থেমে থাকেনি।
এর পিছনের ঘটনা পরম্পরাও কম নয়। গত কয়েক দিন ধরেই রাজভবন থেকে একের পর এক নির্দেশিকা পৌঁছেছে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাছে। কিন্তু গত কয়েক দিনে তা নিয়ে শিক্ষাদফতর বা শিক্ষামন্ত্রীর তরফে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। অবশেষে সোমবার শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক করে রাজ্যপালকে একের পর এক উপমা-বাণে বিদ্ধ করেন।
তালিবান
সোমবার প্রথমেই ব্রাত্য রাজ্যপালের সঙ্গে তুলনা টানেন তালিবান শাসকের। তিনি বলেন, রাজ্যপাল গোটা উচ্চশিক্ষা সিস্টেমকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ব্যাপারে কোনও আলোচনা না করেই ফতোয়া জারি করছেন। এই মনোভাব আসলে তালিবানি মনোভাব।
গোপাল ভাঁড়
এই নামটিই না বললেও শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভার শ্রেষ্ঠ বিদূষকের কথা। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের নবরত্ম সভার শ্রেষ্ঠ বিদূষকটি কে? তা সর্বজনবিদিত। তিনি গোপাল ভাঁড়। যাঁর প্রবল রসবোধের কাহিনি আজও বাংলায় জনপ্রিয়। যদিও গোপালের কীর্তির সঙ্গে রাজ্যপালের কাজের সম্পর্ক কী তা স্পষ্ট করেননি শিক্ষামন্ত্রী। শুধু বলেছেন, ‘‘রাজ্যপাল নিজেই উপাচার্যদের পদে বসাচ্ছেন আবার নিজেই তাড়িয়েও দিচ্ছেন।’’ তবে কি রাজ্যপালের এই ধরনের কাজকে ‘হাস্যকর’ বোঝাতে চেয়েই বিদূষকের (ভাঁড়) প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন ব্রাত্য?
জেমস বন্ড
সাহিত্যের গুপ্তচর নিঃশব্দে শত্রুর ডেরায় ঢুকে কাজ গুছিয়ে চলে আসেন। ব্রাত্য সেই জেমস বন্ডের সঙ্গে রাজ্যপালের তুলনা টেনে বলেছেন, ‘‘ওঁর কাজ নিঃশব্দ প্রহেলিকার মতো। কখন কী করছেন বোঝা যাচ্ছে না। নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। বিভিন্ন উপাচার্যকে অপমান করছেন, শুধু পেটোয়া উপাচার্যরা ছদ্মবেশে রাজভবনে এসে ঢুকছেন। জগদীপ ধনখড় যখন রাজ্যপাল ছিলেন, তখন আলোচনার পরিসর ছিল। এই রাজ্যপালের সঙ্গে আলোচনার কোনও জায়গা নেই। উনি জেমস বন্ডের মতো আচরণ করছেন। বর্তমান রাজ্যপাল বন্ডের মতোই নিঃশব্দ প্রহেলিকার মতো কাজ করছেন।’’ একটা সময় যেই ধনখড়কে নিয়ে রাজ্য সরকারের অনেক আপত্তি ছিল তাঁর এমন প্রশস্তি ইদানীং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও শোনা গিয়েছে। অতীতেও বলেছেন ব্রাত্য। সোমবার আবার শোনালেন।
স্বৈরাচারী
স্বৈরাচারী বললেই মনে পড়ে হিটলারের কথা। জার্মান একনায়কের মতো স্বৈরাচারীরা কখনওই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে আমল দেননি। ব্রাত্য বলেছেন, ‘‘কখনও তিনি উপাচার্য, কখনও আচার্য, কখনও নিজেই উচ্চশিক্ষা দফতর। তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশকে তোয়াক্কা না করে, তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে, নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান করে উচ্চ শিক্ষা দফতরকে বাইপাস করে একতরফা ভাবে উপাচার্য নিয়োগ করে দিচ্ছেন। এই রাজ্যপালের একচেটিয়া স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব দেখাচ্ছেন।’’
ওঝা
রাজ্যপাল অতিপ্রাকৃত শক্তি বা ঝাড়ফুঁকের আশ্রয় নিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন ব্রাত্য। সাধারণত এই ধরনের কাজ করেন ওঝারা। অর্থাৎ, পরোক্ষে রাজ্যপালকে ওঝার সঙ্গেও তুলনা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে রাজ্যপালকে এই ধরনের উপমায় এর আগেও বিদ্ধ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী।
মুড়ি আর চালভাজা
গত ৩১ অগস্ট রাজ্যপাল জানিয়েছিলেন উপাচার্যহীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রয়োজনে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলে নেবেন। সেই বক্তব্যকে কটাক্ষ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘এ তো মুড়ি আর চালভাজা এক হয়ে গেল।’’ যদিও মুড়ি কে? আর চালভাজাই বা কাকে বলতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট করেননি শিক্ষামন্ত্রী। তবে সমঝদাররা ইঙ্গিত বুঝেছিলেন।
মত্ত হাতি
এর আগে রাজ্যপালকে ‘মত্ত হাতি’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হিসাবে যখন অতি সক্রিয় হয়ে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছিলেন রাজ্যপাল, তখন ব্রাত্য বলেছিলেন, উনি মত্ত হাতির মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
রাজ্যের রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী এবং রাজ্যপালের সম্পর্ক এমন ছিল না। প্রথম দিকে বেশ কয়েক বার একযোগে সাংবাদিক বৈঠকও করেছিলেন দু’জনে। কিন্তু তার পরেই বদলে যেতে থাকে সম্পর্কের সমীকরণ। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্যের ভূমিকায় রাজ্যপাল অতি সক্রিয়তা দেখানোর পরই শিক্ষা দফতর অভিযোগ করে, রাজ্যপাল তাদের পাশ কাটিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাথায় নিজের পছন্দের উপাচার্য বসাচ্ছেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর পরোক্ষে উচ্চ শিক্ষা দফতরেরও নিয়ন্ত্রণ আছে। কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে আর্থিক সহায়তা করে সরকার। সেই থেকেই রাজভবনের সঙ্গে শিক্ষা দফতরের সংঘাত শুরু, যা আপাতত থামার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy