আগে খেলতেন কবাডি। এখন তিনি গল্ফও খেলেন! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আগে পরতেন সাদামাঠা রিমলেস ফ্রেমের চশমা। ইদানীং কখনও তাঁর চশমার ফ্রেমে স্ফটিক-দ্যুতি। কখনও হাল ফ্যাশনের স্বচ্ছতা।
আবার কখনও চোখে ব্র্যান্ডেড গগ্লস।
প্রাতঃভ্রমণে পায়ে ‘নজরকাড়া’ স্নিকার্স। পরনে ব্র্যান্ডেড টি-শার্টের সঙ্গে কখনও শর্টস, কখনও ট্র্যাকস্যুট।
আবার সংসদ ভবনের পোর্টিকোয় তাঁকে ইদানীং দেখা যাচ্ছে নামী ব্র্যান্ডের মাস্কে।
আগে খেলতেন কবাডি। এখন তিনি গল্ফও খেলেন!
এই ব্র্যান্ড-সচেতন দিলীপ ঘোষের উদ্ভব হল কবে? কী কারণে?
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন সঙ্ঘের প্রচারক। যেখানে অতি সাধারণ জীবনযাত্রা ছিল বাধ্যতামূলক। ঊর্ধ্বাঙ্গে ফতুয়া বা সাধারণ কুর্তা। নীচে ততোধিক সাধারণ পায়জামা। সঙ্ঘের বিভিন্ন কার্যালয়েই কেটে যেত দিন-রাত। ‘ভোজন’ও সেখানেই। না হলে কোনও স্বয়ংসেবকের বাড়িতে। মোট কথা— সঙ্ঘ যখন, যেখানে, যেভাবে রাখবে, তখন সেখানে, সেভাবেই মানিয়ে নেওয়া। কব্জিতে এখনও সঙ্ঘী বালাটি রয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ সঙ্ঘীজীবনের সুবাদে তাঁর ঘরে এখনও ত্রিশূলের দেখা মেলে। ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনের গেরুয়া বাড়িটির যে ঘরে তিনি বসেন, সেখানে এখনও নিয়মিত পদ্মফুল রাখা হয়। কিন্তু সে সব গেরুয়া পরম্পরার মাঝেও নতুন পদ্ম হয়ে ফুটেছেন দিলীপ।
প্রথমে রাজ্য বিজেপির সভাপতি। তার পর খড়্গপুর সদরের বিধায়ক। তার পরে মেদিনীপুরের সাংসদ হয়ে সোজা দিল্লি। রাজনীতির গ্রাফে দ্রুত উত্থান ঘটেছে তাঁর। ততটাই দ্রুততায় তিনি আবির্ভূত হয়েছেন এক ঝাঁ-চকচকে অবতারে। সঙ্ঘের জীবনদর্শনের সঙ্গে কি খাপ খায় সেই নতুন অবতার? কার পরামর্শে দিলীপের এই ‘মেক ওভার’? আজীবন সঙ্ঘের কাজে নিবেদিতপ্রাণে কি এই বয়সে পৌঁছে নতুন করে ফ্যাশন-সচেতন হয়ে ওঠা সহজ?
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন সঙ্ঘের প্রচারক।
আরও পড়ুন: আদালতের নির্দেশ অমান্যের চেষ্টা, ছটপুজো করতে চেয়ে বিক্ষোভ রবীন্দ্র সরোবরে
লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পাল। এখন তিনি বিজেপি-র মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রী। দলে ‘দিলীপ ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত তিনি। ‘নতুন দিলীপ’ কি তাঁর পরামর্শে? অগ্নিমিত্রা অবশ্য বলছেন, ‘‘আমি দিলীপদাকে কখনও এ সব বিষয়ে কোনও পরামর্শ দিইনি। তবে বরাবরই দেখেছি, দিলীপদা বেশ শৌখিন।’’ ঘটনাচক্রে, দিলীপ এবং অগ্নিমিত্রা, দু’জনকেই ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য করা হয়েছিল। পরে অন্যান্য ব্যস্ততার চোটে দিলীপ সে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। বোর্ডে একসঙ্গে থাকার সুবাদে ২০১৪ সাল থেকেই দিলীপকে চেনেন অগ্নিমিত্রা। তাঁর কথায়, ‘‘তখনথেকেই দেখেছি, দিলীপদা খুব পরিপাটি, খুব শৌখিন। একটা সাধারণ পাঞ্জাবিই হয়তো পরেছেন। কিন্তু সেটাও ধোপদুরস্ত, পাটভাঙা, সুন্দর করে ইস্ত্রি করা। হঠাৎ করে তাঁর পোশাকের বাহার বেড়ে গিয়েছে, আমি অন্তত এমন মনে করি না।’’ দিলীপ বরাবরই ফ্যাশন-সচেতন জানিয়ে অগ্নিমিত্রার ব্যাখ্যা, ‘‘আমি দিলীপ’দাকে দুটো মোদী কোট বানিয়ে দিয়েছিলাম। একটু ডিজাইনার ধরনের। দিলীপদা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেগুলো পরেন। কীসের সঙ্গে সেগুলো পরলে মানায়, সেটা খুব ভাল বোঝেন। কিন্তু উনি নিজে কখনও ওসব কিনে পরেন না।’’
রাজ্যের বিজেপি নেতাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় স্বভাবগত ভাবেই ফ্যাশনদুরস্ত। তার অন্যতম কারণ, তিনি গ্ল্যামারজগৎ থেকে এসেছেন। বলিউডে শুরু তাঁর কেরিয়ার। তাই তাঁর দু’কানে হিরের দুল, হাতে একাধিক রিস্টলেট থাকায় আপাতদৃষ্টিতে কোনও বদল চোখে পড়ে না। কিন্তু ‘বাহারি’ দিলীপ চোখে পড়ছেন।
সঙ্ঘ পরিবারের সাবেক প্রচারকের জীবনযাত্রায় ‘বদল’ প্রথম ধরা পড়েছিল দিলীপের রাজারহাটের বিশাল বাড়িতে উঠে যাওয়ায়। তার পর একে একে নজরে পড়েছে তাঁর চশমা, টি-শার্ট, স্নিকার্স ইত্যাদি। তবে দলে তাঁর অনুগামীদের মতে, ‘‘মর্নিং ওয়াকে টি-শার্ট, শর্টস বা ট্র্যাকস্যুটই তো পরবেন। যে কাজের জন্য যে পোশাক। কেউ সাঁতার কাটতে গেলে নিশ্চয়ই সুইমিং কস্টিউম পরেই যাবে।’’ চশমা নিয়ে শৌখিনতার প্রশ্নে তাঁদের বক্তব্য, ‘‘রোজ বহু লোকের মাঝে যেতে হয়। ভিড়, ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়তে হয়। তাতে চশমা অনেক বার ভাঙে। তাই একাধিক চশমা রাখার দরকার পড়ে।’’
‘বাহারি’ দিলীপ চোখে পড়ছেন।
রাজ্য বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসুর কথায়, ‘‘দিলীপ ঘোষকে যাঁরা কয়েক মাস বা কয়েক বছর চিনছেন, তাঁরা ওসব বলবেন। আমি ওঁকে ১৫ বছর ধরে চিনি। উনি বরাবরই টি-শার্ট পরেন। মর্নিং ওয়াকেও বরাবর যান। ওঁর জীবনের রুটিন কোথাও বদলায়নি। আগেও ভোর সাড়ে ৪টেয় উঠতেন আর রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে শুয়ে পড়তেন। এখনও তাই।’’ তবে পাশাপাশিই সায়ন্তন বলছেন, ‘‘আগে দিলীপ ঘোষ শুধু সঙ্ঘের প্রচারক ছিলেন। এখন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি এবং সাংসদ। আগের চেয়ে ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে, কাজের চাপ বেড়েছে, পরিশ্রম বেড়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে জীবনে কিছু পরিবর্তন তো আসেই। সেই কারণেই তাঁকে কনভয় নিয়ে ঘুরতে হয় বা তাঁকে নিরাপত্তারক্ষীরা ঘিরে রাখেন। এ সবও তো আগে ছিল না।’’
সায়ন্তনের কথায়, ‘‘দিলীপ ঘোষ প্রচুর টাকা করেছেন এবং সে সব দিয়েই শখ-শৌখিনতা পূরণ করছেন, এমন ভাবার কিন্তু কোনও কারণ নেই। তাঁর জামাকাপড়, তাঁর জুতো, তাঁর মোবাইল, সব দল দেয়। তিনি যে বাড়িতে থাকেন, দল তার ভাড়া দেয়। তিনি যে গাড়িতে চড়েন, সেটাও দলেরই দেওয়া গাড়ি। তাই অযথা জল্পনা তৈরি করে লাভ নেই।’’
আর দিলীপ নিজে কী বলছেন?
গেরুয়া পরম্পরার মাঝেও নতুন পদ্ম হয়ে ফুটেছেন দিলীপ।
আরও পড়ুন: বাইডেন বাঙালির মাহাত্ম্য বোঝেন, দিল্লি বোঝে না
বলছেন, ‘‘অনেক কথাই বলা হচ্ছে। ইচ্ছা করে রটানো হচ্ছে। কেউ বলছেন, ২৫ হাজার টাকার জুতো পরছি। ১৫ হাজার টাকার জামা পরছি। আসলে জুতোর দাম ২৫ হাজার টাকা না ২৫০ টাকা, সেটা তো কেউ যাচাই করে দেখছেন না। তাই ওসব নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই।’’ আর কী বলছেন? বলছেন, ‘‘রাজনীতি করতে এসেছি। রাজনীতিটা ক্ষত্রিয়ের কাজ। সুতরাং রাজনীতিকের আচরণও সে রকমই হওয়া উচিত। অনেকে বলছেন, দিলীপ ঘোষ গল্ফ কেন খেলছেন? গল্ফ খেলায় কী অন্যায় দেখলেন? আগে কবাডি খেলতাম। এখন তার সঙ্গে গল্ফও খেলি। রাজনীতিতে এলে সব ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। আগে গল্ফ খেলা লোকেদের সঙ্গে মেশার খুব প্রয়োজন হত না। এখন যাঁদের সঙ্গে মিশি, তাঁদের মধ্যে গল্ফ খেলা লোকেরাও রয়েছেন। তাই খেলি।’’
আর সবশেষে, ‘‘এসব দেখে অনেকে জ্বলছেন জানি। তাঁরা চান, দিলীপ ঘোষ ভিখারি বেশে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু তা হবে না! দিলীপ ঘোষ ভিখারি বেশে ঘুরবে না। যাঁরা জ্বলছেন, জ্বলুন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy