অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো তৈরি করেই চলছে উদ্ধারকাজ। ছবি: পিটিআই।
ঘোলা ঘূর্ণি জলে কখনও ভেসে আসছে হাতের আঙুল, কানের টুকরো। কখনও আবার পায়ের অংশ। বহন ক্ষমতা হারিয়ে জলপাইগুড়ির নদীপারে রোজ কত কত দেহ আর দেহাংশ জমা করছে তিস্তা, তার ঠিকঠাক হিসাব প্রশাসনের কাছেও নেই! রবিবারও উত্তরবঙ্গের তিস্তাপার থেকে মিলল ১১ জনের দেহ। অন্য দিকে, খারাপ আবহাওয়ার কারণে গত চার দিন ধরে বিপর্যস্ত উত্তর সিকিমে উদ্ধারকাজ চালাতেই পারেনি সেনাবাহিনী। রবিবার সেই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। উত্তর সিকিমের ডংজু , চুংথাং এবং পেগিওয়ং থেকে বেশ কয়েক জনকে সড়ক পথেই নীচে নামিয়ে আনা হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় তিস্তার তাণ্ডবে সেতু ভেঙে পড়ায় সেখানে অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো তৈরি করেই চলছে উদ্ধারকাজ।
সিকিম বিপর্যয়ের পর গত দিন চারেক ধরে একের পর এক দেহ ভেসে এসেছে তিস্তাপারে। ভেসে আসা দেহাংশ নদীতটেই ছিঁড়ে খেয়েছে শিয়াল-কুকুরে! শেষ কবে এই ভয়াবহ ছবি দেখেছে জলপাইগুড়ি, তা মনে করতে পারছেন না কেউই। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, রবিবার পর্যন্ত ৪০ জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে। তার কোনওটি সেনা জওয়ানের, কোনওটি সাধারণ বাসিন্দার। জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালের মর্গে উদ্ধার হওয়া দেহের ময়নাতদন্ত চলছে। এখনও পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ৩৮টি দেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। তার মধ্যে ১০ জনের দেহ শনাক্ত করা গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে ছ’জন সেনা জওয়ান এবং চার জন সাধারণ নাগরিক। ১০ জনকেই পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
নদী বিশেষজ্ঞদের মত, জলপাইগুড়ি এবং লাগোয়া তিস্তাপার থেকে আরও দেহ উদ্ধারের আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, সেবক পর্যন্ত পাহাড়ি পথে তিস্তা নদী খরস্রোতা। সেবক পার হওয়ার পর থেকে স্রোত কমে। কমে যায় নদীর বহন ক্ষমতাও। তাই গজলডোবা ব্যারাজ হয়ে জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া সেতুর আশপাশে এসে দেহ ও দেহাংশ আর বইতে পারছে না তিস্তা। পাহাড় থেকে নদী খাতের বড় বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে ছিন্নভিন্নও হয়ে যাচ্ছে কিছু দেহ। আরও দেহ ভেসে আসতে পারে, এমন আশঙ্কা করেই জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দল জলপাইগুড়িতে রেখে দেওয়া হয়েছে। একটি দলকে রাখা হয়েছে জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানায়। তিস্তায় নৌকা নামিয়ে দেহের খোঁজ চলছে।
বুধবার গোটা দিন জুড়েই সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে পাহাড়ি এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে তিস্তা। তার পর বৃহস্পতিবার থেকে উদ্ধারকাজ শুরু হলেও উত্তর সিকিমের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সেখানে আটকে পড়া পর্যটকদের সংখ্যাই ঠিক করে জানা যায়নি এত দিন। ধীরে ধীরে স্যাটেলাইট ব্যবস্থার মাধ্যমে যোগাযোগ গড়ে তোলা গিয়েছিল বটে, শনিবার পর্যন্ত উত্তর সিকিমের লাচেন, লাচুং থেকে পর্যটকদের ফেরানো সম্ভব হয়নি। রবিবার আবহাওয়ার খানিক উন্নতি হওয়ায় এ বার উত্তর সিকিমেও উদ্ধারকাজ শুরু করল সেনাবাহিনী এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা। সিকিম প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, উত্তর সিকিমের ডংজু , চুংথাং এবং পেগং থেকে বেশ কয়েক জনকে সড়কপথেই নীচে নামিয়ে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই শ্রমিক এবং কয়েক জন পর্যটক রয়েছেন। সেনা সূত্রে খবর, তাঁদের কিছুটা রাস্তা হাঁটিয়ে এনে তার পর গাড়ি করে গ্যাংকটে নিয়ে আসা হয়। তিস্তার জলের তোড়ে চুংথাং এবং পেগংয়ের সংযোগকারী সেতুটি ভেসে গিয়েছিল। সেখানে বাঁশের সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। পায়ে হেঁটে এ পার-ও পার করা যাচ্ছে ওই সেতু দিয়ে। অন্যান্য জায়গাতেও উদ্ধারকাজে এই কৌশল নিয়েছে সেনা ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। যদিও হেলিকপ্টারে করে উদ্ধারকাজ শুরু করা যায়নি বলেই খবর সেনা সূত্রে।
হিমালয়ান হসপিট্যালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজ়ম ডেভলপমেন্ট নেটওয়ার্কের সম্পাদক সম্রাট সান্যাল বলেন, ‘‘উত্তর সিকিমের ডংজু গ্রাম থেকে ১০ জনকে উদ্ধার করে গ্যাংটকে নামিয়ে আনা হয়েছে। আবহাওয়ার কারণে এখনই এয়ারলিফ্ট সম্ভব নয়। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, আইটিবিপি অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সড়ক ব্যবস্থার যতটুকু হোক উন্নতি করে পর্যটকদের নামিয়ে আনতে। কিছুটা পায়ে হাঁটিয়ে, কিছুটা গাড়ি করে উদ্ধার করা হচ্ছে পর্যটকদের। চিত্রে থেকে রংপো পর্যন্ত রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ছোট গাড়িই নয়, পণ্যবাহী বড় গাড়িও সেখান দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।’’
সিকিম সরকারের তরফে শনিবার বার্তা দেওয়া হয়েছে, পর্যটকেরা সেখানে সুরক্ষিত রয়েছেন। হোটেল, গেস্ট হাউস, সরকারি ভবনগুলিতে পর্যটকদের নিখরচায় থাকা-খাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারের তরফে। তবে গত কয়েক দিনে তাঁদের উদ্ধারের তেমন কার্যকরী ব্যবস্থা না হওয়ায় সমস্যা বাড়ছে। কারণ, রাস্তার যা পরিস্থিতি, তাতে ওই সব অংশে পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে, উত্তর সিকিমের লাচুং ও লাচেন এলাকায় দেড় হাজারের মতো পর্যটক আটক রয়েছেন এখনও। যদিও, বেসরকারি হিসাবে বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থাগুলোর তরফে জানানো হয়েছে, সংখ্যাটা আড়াই হাজারের কাছাকাছি। প্রশাসন এবং ভ্রমণ সংস্থাগুলির তরফে জানা গিয়েছে, অন্তত ১৫৭০টির মতো গাড়ি পর্যটকদের নিয়ে গত কয়েক দিনে সিকিম থেকে নেমেছে। সেই সব গাড়িতে শ্রমিক, পড়ুয়া, স্থানীয় কিছু মানুষও নেমেছেন। সব খোঁজখবর নিয়ে জানা গিয়েছে, পুরো সিকিমে আটকে থাকা পর্যটকের সংখ্যা প্রথমে যতটা মনে করা হচ্ছিল, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। সিকিমে এখনও চার হাজারের কাছাকাছি পর্যটক আটকে রয়েছেন বলে ওই সব সংস্থার দাবি।
তিস্তাবাজার পরিদর্শনে রাজ্যপাল
রবিবার দুপুরে দার্জিলিঙের রাজভবন থেকে বেরিয়ে কালিম্পঙের নয়া তিস্তাবাজার এলাকা পরিদর্শন করেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। দার্জিলিং থেকে কার্শিয়াং হয়ে পেসকের রাস্তা ধরে ত্রিবেণী হয়ে নয়া তিস্তাবাজারে পৌঁছান রাজ্যপাল। সেখানে গোটা এলাকা পরিদর্শন করে কথা বলেন বন্যার্তদের সঙ্গে। তাঁদের সুবিধা-অসুবিধার খবর নেন তিনি। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে রাজ্যপাল বলেন, ‘‘দুঃখজনক ঘটনা। প্রকৃতির এই ধ্বংসলীলার সম্মুখীন সাধারণ মানুষ। যদিও বা এই ধ্বংসলীলা মানুষের দ্বারাই সৃষ্ট। সময় এসেছে। আমাদের সচেতন হতে হবে। পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। এই মুহুর্তে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমাদের সকল ভাইবোনেদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া। কেন্দ্র থেকে রাজ্য সকলকে একসঙ্গে এগিয়ে এসে কাজ করতে হবে। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তিস্তা কবলিত এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের অনুভূতিকে বোঝার চেষ্টা করছি।’’
কালিম্পং পরিদর্শনে মন্ত্রী অরূপ
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নির্দেশে কালিম্পংয়ের বিপর্যস্ত এলাকা পরিদর্শন করলেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। শনিবার কালিম্পংয়ের তিস্তাবাজার সংলগ্ন এলাকা পরিদর্শনের পর রবিবার বিকেলে রংপো এলাকা পরিদর্শন করেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ, প্রাক্তন সাংসদ শান্তা ছেত্রী, শিলিগুড়ি পুরনিগমের মেয়র গৌতম দেব ও ডেপুটি মেয়র রঞ্জন সরকার, জিটিএ চিফ এগজ়িকিউটিভ অনিত থাপা। হড়পা বানের ফলে কালিম্পংয়ের রংপো এলাকারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখে অরূপ বলেন, ‘‘কালিম্পংয়ের রংপো এলাকারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গতকাল আমরা তিস্তাবাজার সংলগ্ন এলাকা পরিদর্শন করেছি। প্রয়োজনীয় সামগ্রী যাতে সঠিক সময়ে বিপর্যস্ত এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা দেখছি। মুখ্যমন্ত্রী সব সময়েই নজর রাখছেন পরিস্থিতির উপর।’’ ফের কেন্দ্রীয় সরকারকে একহাত নিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও বাংলার প্রতি বঞ্চনা করছে কেন্দ্র। বাংলার আবাস যোজনা হোক বা ১০০ দিনের কাজ, সব ক্ষেত্রেই বঞ্চনা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy