শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে বৈঠক করার পরে তাঁরা যে আশ্বস্ত হতে পারেননি, তা বৈঠক শেষেই বলে দিয়েছিলেন চাকরিহারা শিক্ষকেরা। শনিবার তাঁদের একাংশ জানালেন, যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের হাতে ওএমআর শিট তুলে দেওয়ার দাবিতে আগামী ১৪ এপ্রিল স্মারকলিপি পেশের কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। অন্য দিকে, ‘যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ ২০১৬’-এর অন্যতম প্রধান মুখ মেহেবুব মণ্ডল বলেন, “রিভিউ পিটিশনে ন্যায় বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের নানা কর্মসূচি চলবে।”
যদিও তাঁরা কোথায় বসে অবস্থান বিক্ষোভ দেখাবেন, তা নিয়ে পরে মত বদল হয়। প্রথমে তাঁরা গান্ধীমূর্তির পাদদেশে বসলেও পরে পুলিশ তাঁদের জানায়, হাই কোর্টের নির্দেশে রবিবার থেকে সেখানে অবস্থানে বসবেন ২০১৬-র প্যানেলের ওয়েটিং লিস্টে থাকা লোকজনেরা। তার পরেই মেহেবুব জানান, তাঁরা স্থানবদল করে আপাতত ওয়াই চ্যানেলে ধর্না অবস্থান চালাবেন। সেখান থেকেই তাঁরা পরবর্তী কর্মসূচিও পালন করবেন। একই সঙ্গে মেহেবুব বলেন, “জেলায় অঞ্চল ভিত্তিক আন্দোলন হবে। আগামী ২১ এপ্রিলের মধ্যে এসএসসি যোগ্য-অযোগ্য বিভাজনের তালিকা না দিলে, আবার এসএসসি ভবন ঘেরাও অভিযান হতে পারে।”
এ দিকে, সল্টলেকের এসএসসি ভবনের কাছে এখনও তিন জন শিক্ষক অনশন চালাচ্ছেন। অনশনকারী সেই প্রতাপকুমার সাহা, সুমন বিশ্বাসেরা শনিবার সকালে বলেন, “আমাদের অনশন তিন দিনে পা দিল। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে গত কালকের বৈঠকে সমাধানসূত্র মেলেনি। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী ২১ তারিখের মধ্যে আইনের দিক খতিয়ে দেখে ২২ লক্ষ চাকরিপ্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করবেন। সেখানে যোগ্য-অযোগ্য তালিকা থাকবে। কিন্তু ওই তালিকা তো সুপ্রিম কোর্ট বা হাই কোর্টে স্বীকৃতি পায়নি। তাতে আমাদের কী লাভ হবে?” এ দিন সকালে ওই অনশনকারীরা তাঁদের অনশন মঞ্চের উপরে চাদর বিছিয়ে ছাউনি দিতে গেলে পুলিশ বাধা দেয় বলেও অভিযোগ। পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে, উচ্চপদস্থ কর্তাদের অনুমতি ছাড়া ছাউনি দেওয়া যাবে না।
প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী, পরে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হল চাকরিহারা শিক্ষকদের। কিন্তু তাতে আদৌ লাভ কী হল, এ দিনও প্রশ্ন তুলেছেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। চাকরিহারা শিক্ষিকা পায়েল বণিক বলেন, “খুবই অসহায় অবস্থার মধ্যে আছি। আমি সংসারের একমাত্র রোজগেরে। স্বামী দু’বছর আগে পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আমার পাঁচ বছরের ছেলের জুভেনাইল ডায়াবিটিস। তাকে রোজ ইনসুলিন ইনজেকশন দিতে হয়। বয়স্ক মা-বাবাকেও তো দেখতে হয়। এই অবস্থায় কী করব, বুঝতে পারছি না।”
জেলায় এ দিন চাকরি হারানো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপরে পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে পথে নামে ছাত্রছাত্রীরা। শনিবার মিছিল করে বা স্মারকলিপি দিয়ে ওই শিক্ষকদের ক্লাসে ফেরানোর দাবিও জানায় তারা। নানা সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলগুলিও প্রতিবাদ কর্মসূচি নেয়।
কোচবিহারে বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়ারা মিছিল করে। মাথাভাঙা গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রীরা স্কুলের গেটে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়। বাঁকুড়ার রানিবাঁধের ঝিলিমিলি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মৌনী মিছিল করে। কালো ব্যাজ পরে হাঁটেন শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক অসিতবরণ মাহাতো বলেন, “স্কুলের ন’জন শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। আমাদের দাবি, যোগ্যদের পুনর্বহাল করা হোক।”
চাকরি হারানো দুই শিক্ষক-শিক্ষিকা আর স্কুলে না আসায় পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে— এই অভিযোগে পশ্চিম বর্ধমানের অন্ডাল উচ্চ বিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রছাত্রী স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের কাছে স্মারকলিপি দেয় এ দিন। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক মৃণালকান্তি সাহা বলেন, “শীঘ্র ওই শিক্ষকেরা স্কুলে ফিরুন, সেটাই চাই। দ্রুত সমস্যা না মিটলে, পড়ুয়াদের স্বার্থে বিকল্প ব্যবস্থা ভাবতে হবে।” রায়গঞ্জের বামনগ্রাম হাসিমুদ্দিন হাই স্কুলের শিক্ষকেরা স্কুলে কালো ব্যাজ পরে প্রতিবাদ জানান। মৌনী মিছিল করেন বীরভূমের রামপুরহাটে জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবনের শিক্ষকেরা। কর্মরত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের একাংশ শুক্রবার সন্ধ্যায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরে মিছিল করেন।
‘শিক্ষক ও নাগরিক সমাজ’ নামে এক সংগঠন পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে মিছিল ও পথসভা করে। ‘মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি’র (এসটিইএ) উদ্যোগে হুগলির আরামবাগের নেতাজি স্কোয়্যারে সভা হয়। চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরাও ছিলেন সেখানে।
হলদিবাড়িতে মিছিল করে ‘রাইট টু এডুকেশন ফোরাম’। রায়গঞ্জ থানার সামনে বিক্ষোভ দেখায় ‘সেভ এডুকেশন কমিটি’। মেদিনীপুর শহরে শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ এবং তারকেশ্বর, কালিয়াগঞ্জে বিজেপি মিছিল করে। কাঁথিতে এডিআই অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখায় আরএসএস প্রভাবিত ‘অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘ’।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)