—প্রতীকী ছবি।
‘বর্ষে বর্ষে দলে দলে আসে বিদ্যামঠতলে, চলে যায় তারা কলরবে।’ না, এ বার কলরব করতে করতে নয়, ‘চেনা মুখের সারি’ চলে গিয়েছে নীরবে, দৃষ্টিপথের বাইরে দিয়ে। আবার নতুন মুখগুলিও ‘চেনা’ হয়ে ওঠেনি। এর মধ্য দিয়েই কেটে গিয়েছে আস্ত একটা বছর!
২০২০ সালের ১৪ মার্চ করোনা-আতঙ্কে আচমকা স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। তার পরেই শুরু হয় দেশজোড়া লকডাউন। লকডাউন শিথিল হয়ে দোকান, বাজার, শপিং মল খুলেছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রাঙ্গণে স্বাভাবিকতা ফেরেনি। এর মধ্যেই স্কুল-কলেজের চূড়ান্ত বর্ষের পড়ুয়ারা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গিয়েছেন। বিদায়বেলায় শিক্ষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি তাঁদের। নতুন যাঁরা প্রতিষ্ঠানে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গেও আলাপ হয়নি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ ভাবে বন্ধ থাকায় পঠনপাঠনের ক্ষতি তো হচ্ছেই। সেই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ‘স্বাভাবিক’ সম্পর্কের অভাবে মানসিক কষ্টে ভুগছেন বহু শিক্ষক-শিক্ষিকাও।
স্কুলশিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষাজগতের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেকে পড়ুয়ার। যা স্কুলছুটের হার বাড়িয়ে দিতে পারে। বর্ধমানের গোলগ্রাম গোলাম ইমাম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কৌশিক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নবম শ্রেণির এক পড়ুয়ার বাবা জানিয়েছেন, লকডাউনের পরে তাঁর ছেলে সাইকেলের দোকানে কাজ নিয়েছে।’’ রায়নার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অমৃতা পাটসা খবর পেয়েছেন, গত ক’মাসে তাঁদের কয়েক জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বহু স্কুলে এ বার দ্বাদশ শ্রেণির সব পড়ুয়া উচ্চ মাধ্যমিকের ফর্ম পূরণ করেননি। শিক্ষকদের একাংশের মতে, প্রত্যন্ত এলাকায় বা আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের সন্তানেরা সে-ভাবে অনলাইন ক্লাসের সুযোগ পায়নি। পড়াশোনা থেকে বিচ্যুত হয়েছে তারা। যদিও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, স্কুলছুটের খবর নেই।
অনেক শিক্ষকের বক্তব্য, ক্লাসে সশরীরে হাজির থাকলে যে-ভাবে পড়াশোনা হয়, অনলাইনে সেটা সম্ভব নয়। যে-সব পড়ুয়া অনগ্রসর পরিবার থেকে আসে, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বেশি। শুধু পড়াশোনার সমস্যা নয়, পড়ুয়াদের নানা মানসিক জটিলতাও তাদের মুখ দেখেই বুঝে নিতে পারেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এই সমস্যা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়— সব ক্ষেত্রেই সমান। ক্যালকাটা উইমেন ক্রিশ্চান কলেজের সমাজতত্ত্বের শিক্ষিকা টুম্পা মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘পড়ুয়ারা পড়া বুঝছে কি না, সেটা ক্লাসে মুখ দেখেই বোঝা যায়। সেটা বুঝে নিয়ে কখনও কখনও বিষয়টিকে সহজতর করে উত্থাপন করতে হয়। অনলাইনে সেই সুবিধা নেই। অনেক মানসিক কষ্ট, ব্যক্তিগত সমস্যার ক্ষেত্রেও শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়ুয়াদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।’’ তাঁর উপলব্ধি, অনলাইন কখনওই ক্লাসঘরের বিকল্প হতে পারে না।
সমস্যাটা যে এমন জায়গায় পৌঁছবে, গত বছরের ১৪ মার্চ বহু শিক্ষক-শিক্ষিকাই তা বুঝে উঠতে পারেননি। ‘‘তখন ভেবেছিলাম, যাক কিছু দিন ছুটি পাওয়া গেল। এখন ক্লাসে ফিরতে না-পেরে খুবই কষ্ট হচ্ছে,’’ বলেন টুম্পাদেবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ল্যাবরেটরি অপরিহার্য। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনলাইনে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস করানো যাচ্ছে না। ওই শিক্ষক বলছেন, ‘‘ল্যাবরেটরিতে পড়াশোনার ফাঁকে পড়ুয়াদের হাসিঠাট্টা, খুনসুটির অভাব আমার মনেও বিঁধছে।’’
অতিমারির প্রতিষেধক প্রদানের কাজ শুরু হয়েছে। বেজে গিয়েছে ভোটের বাদ্যি। সে-সব মিটিয়ে ফের কবে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে ক্লাসঘর, তারই অপেক্ষায় শিক্ষা শিবির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy