Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
সিউড়ির স্কুলের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ নিগৃহীত শিক্ষকের পরিবার

মুখে জানিয়েই দায় সারল স্কুল

ক্লাসঘরের বাইরে শিক্ষককে মাটিতে ফেলে লাথি, ঘুষি মেরে সোমবার হাসপাতালে পাঠিয়েছিল একদল লোক। ঘটনার পর ২৪ ঘন্টা কেটে গেলেও ডিআই (মাধ্যমিক) অফিসে মৌখিকভাবে ঘটনার কথা জানিয়েই ‘দায় সারল’ নিগৃহীত শিক্ষক পার্থপ্রতীম মুখোপাধ্যায়ের স্কুল সিউড়ি শহর লাগোয়া লাঙুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ!

শিক্ষক পার্থ মুখোপাধ্যায়কে মারধরে গ্রেফতার হয়নি কেউ। শিক্ষকদের বিক্ষোভ ডিআই অফিসে।—নিজস্ব চিত্র।

শিক্ষক পার্থ মুখোপাধ্যায়কে মারধরে গ্রেফতার হয়নি কেউ। শিক্ষকদের বিক্ষোভ ডিআই অফিসে।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৫ ০১:২৪
Share: Save:

ক্লাসঘরের বাইরে শিক্ষককে মাটিতে ফেলে লাথি, ঘুষি মেরে সোমবার হাসপাতালে পাঠিয়েছিল একদল লোক। ঘটনার পর ২৪ ঘন্টা কেটে গেলেও ডিআই (মাধ্যমিক) অফিসে মৌখিকভাবে ঘটনার কথা জানিয়েই ‘দায় সারল’ নিগৃহীত শিক্ষক পার্থপ্রতীম মুখোপাধ্যায়ের স্কুল সিউড়ি শহর লাগোয়া লাঙুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ! এ দিনও তাঁরা পুলিসের কাছে কোনও লিখিত অভিযোগ জানায়নি। ঘটনার গ্রেফতারও হয়নি কেউ।

মঙ্গলবার সিউড়ি সদরে ডিআই মহাদেব সরেনের কাছে ওই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সন্তোষ ভাণ্ডারী সব অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, ‘‘গতকাল ওঁর চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। পার্থবাবুর ভাই অভিযোগ করছে বলে আমরা আর অভিযোগ করিনি। তবে আজকে ডিআইকে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানিয়েছি।’’ এত বড় ঘটনার পর এ ঘটনা মৌখিকভাবে জানানো হল কেন? সদুত্তর মেলেনি তার।

স্কুল কর্তৃপক্ষের এ হেন উদাসীনতার পাশেই ধরা পড়ল অন্য ছবি। এ দিন লাঙুলিয়ার ওই স্কুলে ঘটনার কিনারা না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস না করার দাবি জানিয়েছিল উঁচু ক্লাসের পড়ুয়ারা। সে কথা সন্তোষবাবুই মেনে নেন। ছাত্ররা তাদের প্রিয় স্যার পার্থবাবুর প্রতি অন্যায় আক্রমণের কিনারা না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস করবে না বলে জানায়। অভিভাবকদের ও ছাত্রছাত্রীদের তরফে একটি অংশ জানায়, আজ বুধবার, তাঁরা শিক্ষক নিগ্রহের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখাবে স্কুলে।

প্রিয় শিক্ষক পার্থবাবু সম্পর্কে নবম শ্রেনির ছাত্রী নিশা মণ্ডল, অর্পিতা দাস, দশম শ্রেণির টিয়া দাস, গৌতম দলুইদের অভিমত, ‘‘এমন শিক্ষকের কোনও তুলনা হয় না। ওঁর কিছু হলে বা উনি স্কুল থেকে চলে গেলে আমাদের মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’’ মঙ্গলবার সন্তোষবাবু অবশ্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পার্থবাবুর এই জনপ্রিয়তা স্বীকার করেননি।

সোমবারই জানা গিয়েছিল, ওই শিক্ষক এবং পড়ুয়াদের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অভিভাবকদের একাংশের আপত্তি তৈরি হচ্ছিল। ওই অভিভাবকদের অভিযোগ, পার্থবাবুর সঙ্গে মেলামেশা করে ছেলেমেয়েরা ‘বড় বেশি স্বাধীনচেতা’ হয়ে উঠছে। এমনকী, বাড়ির লোকেদের কথাও তারা শুনতে চাইছে না। যদিও, একেবারে উলটো কথা বলছে ছাত্র-ছাত্রীরা। অসন্তোষ চরমে ওঠে গ্রীষ্মের ছুটির আগের একটি ঘটনায়। পার্থবাবুর নামে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র কটূক্তি করেছে এই দাবিতে ওই শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ কিছু ছাত্র ছেলেটির কান ধরে ওঠবোস করায় বলে অভিযোগ। তা জানাজানি হতে ক্ষোভ ছড়ায় অভিভাবকদের মধ্যে। তাঁরা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে এর বিহিত চান। কিন্তু স্কুল খোলার পরেও এ নিয়ে ফয়সালা না হওয়ায় এ দিন পুরনো রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

তাহলে কি পার্থবাবুর জনপ্রিয়তাই সোমবারের ঘটনার পিছনে প্রধান কারণ হয়ে উঠেছিল?

ধনঞ্জয়বাবু বলেন, ‘‘সোমবার দাদা হেনস্থা হতে পারেন জেনেও স্কুলে গিয়েছিলেন দায়িত্ব পালন করতে। দাদা সুস্থ হলেই সব জানাব।’’ এ দিকে স্কুলের একটি সূত্রের দাবি, শুধু সহ শিক্ষককেরাই নন স্কুলে অন্য কারওকেই বিশেষ পাত্তা দিতেন না পার্থবাবু। নিজের মতো থাকতেন। পাত্তা পেত না তৃণমূল প্রভাবিত বিদ্যালয় পরিচালিত সমিতিও। কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তিনি তা মানতে চাইতেন না বলে জানিয়েছেন পরিচালন সমিতির সদস্যদের একাংশ। ফলে অভিভাবকদের যে ক্ষোভ সেই ক্ষোভকে প্রশমিত করার বদলে তাঁকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার পেছনে মদত ছিল।

তৃণমূলের খটঙ্গা অঞ্চল সভাপতি তথা স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি সঞ্জিত রায় অবশ্য এই অভিযোগ মানেননি। তিনি বলেন, ‘‘এভাবে স্কুল চলাকালীন এক শিক্ষককে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে মারা অন্যায়। দোষীরা যেন শাস্তি পায়। যিনি মার খেয়েছেন, তিনিই নাম বলুন। অন্যায় ভাবে কোনও অভিভাবককে ফাঁসাবো কেন।’’

আহত শিক্ষক পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায়কে আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে সিউড়ি হাসপাতাল এবং পরে দুর্গাপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এ দিন পার্থবাবুর শারিরীক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। পার্থবাবুর ভাই ধনঞ্জয় মুখোপাধ্যায় মঙ্গলবার বিকালে দাবি করেছেন, ‘‘কে কে পিছনে আছে আমি বলতে পারব না। দাদা সুস্থ হলেই জানা যাবে। তবে একজন শিক্ষক যিনি দেরি হয়ে গেলে হাজিরা খাতায় সই না করে ক্লাস নিতেন, পড়ুয়াদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন, তাঁদের জন্য সমানে লড়তেন, তাঁকে অন্যরা ভালচোখে দেখবেন না সেটাই তো স্বাভাবিক।’’

প্রশ্ন ওঠে, শিক্ষক নিগ্রহের পর ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও স্কুল কর্তৃপক্ষের গা-ছাড়া ভাব নিয়ে। মঙ্গলবার নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকেও ওই শিক্ষকের উপর বর্বরোচিত আক্রমণের ঘটনার প্রতিবাদে ডিআই(মাধ্যমিক)কে একটি স্মারকলিপি দেয়। সমিতির জেলা সম্পাদক মহম্মদ নুরউজ্জামান বলেন, ‘‘অত্যন্ত বর্বরোচিত ঘটনা। এর প্রতিবাদেই আমাদের স্মারকলিপি।’’

ঘটনার পরে ওই শিক্ষকের পরিবারকে বিষয়টি না জানানো এবং কোনও অভিযোগ দায়ের না করায় স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন নিগৃহীত শিক্ষকের ভাই ধনঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। পুলিশ তাঁর দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তদন্তে নামলেও ঘটনার পর মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারকে পার্থবাবুর নিগ্রহের ঘটনার তদন্ত নিয়ে জানতে ফোন করলে, তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও কোনও উত্তর দেননি।

অন্য বিষয়গুলি:

teacher assault case suri langulia suri teacher beaten suri teacher assault parthapratim mukhopadhyay teacher parthapratim mukhopadhyay suri di office suri khatanga khatanga tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy