E-Paper

‘কই, আমরা তো এ সব জানি না!’

চা গাছের মাথা কেটে ফেললে আর ফুল ফোটে না। ফুল শুধু ঝাঁকড়া মাথায় বেড়ে ওঠা চা গাছেই ফোটে। অর্থাৎ, যে বাগানে কাজ হচ্ছে না বা কম হচ্ছে, গাছের যত্ন নেওয়া হচ্ছে না, সেই বাগানে চায়ের ফুল ফোটে।

An image of the tea worker\\\'s wife

মৃত চা শ্রমিক সুশীল ওরাওঁয়ের স্ত্রী শুকুরমণি (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

অনির্বাণ রায় ও সুমন দাস

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:৩৯
Share
Save

যে ফুল খাদ্য, সেই ফুলেই লুকিয়ে আছে কাঁটা।

শীতের শুরুতে ঘন সবুজ বাগিচায় ফুটেছে চা ফুল। বন্ধ আর রুগ্‌ণ চা বাগানে এই ফুল ভাজা খেয়েই খিদে মেটাচ্ছে শ্রমিকের পরিবার। অথচ, এই ফুলই ইঙ্গিত দিচ্ছে তাদের বিপদসঙ্কুল ভবিষ্যতের। কেন? উত্তরের চা বাগানে কান পাতলে শোনা যায়, ফুল ফোটা আদতে চা বাগানের ‘বড় দুঃখ।’ শীতে পাতা তোলা বন্ধ করে চা গাছগুলির মাথা কেটে ফেলা হয়। তার পরে সেই গাছকে এমন ভাবে যত্ন নেওয়া হয় যাতে, বসন্তের গোড়ায় তাতে সবুজ পাতা বার হয়।

চা গাছের মাথা কেটে ফেললে আর ফুল ফোটে না। ফুল শুধু ঝাঁকড়া মাথায় বেড়ে ওঠা চা গাছেই ফোটে। অর্থাৎ, যে বাগানে কাজ হচ্ছে না বা কম হচ্ছে, গাছের যত্ন নেওয়া হচ্ছে না, সেই বাগানে চায়ের ফুল ফোটে। সেই বাগানের তাই ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সেখানে পরের মরসুমে চা কেমন হবে, তার স্বাদই বা কতটা ভাল হবে, সব কিছু নিয়েই সংশয় থাকে। ফুল ফুটলে তাই বসন্ত নয় বাগানে। বরং সুমনের গানের কথা একটু বদলে কেউ কেউ বলেন, ‘নিজের ভবিষ্যৎকেই খাচ্ছেন বাগানের শ্রমিকরা’।

বাগানে এমন কাঁটা ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তর।

ঢেকলাপাড়া চা বাগানে যেমনটা দেখা গিয়েছিল। সদ্য দু’দিন হল মুখ্যমন্ত্রী পরপর সভা করে গিয়েছেন চা বলয়ে। বিরোধী দলনেতা সভা করতে আসবেন আরও দু’দিন পরে। বন্ধ ঢেকলাপাড়া বাগানে ব্যস্ততাহীন বিকেলে হঠাৎই শ্রমিকদের চা সুন্দরী ঘরের সামনে ছোট একটা ভিড়। শ্রমিকদের এই ঘর তৈরি করে দিয়েছে রাজ্য। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে লোকজন বলাবলি করছে, “এত দুর্বল ছিল সুশীল! কয়েক ঘণ্টার জ্বরের ধকলও নিতে পারল না শরীরটা।’’ ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করত না কি?” চোখের জল সামলাতে সামলাতে সুশীলের স্ত্রী শুকুরমণি বললেন, “করত। ভাত আর ঢেকি শাক, কোনও দিন কচুশাক।”

গত ১৪ ডিসেম্বর তত ক্ষণে ফোন চলে গিয়েছে বীরপাড়া রাজ্য সাধারণ হাসপাতালের কর্তার কাছে, বলছেন শ্রমিকরা। জ্বরে কাতরাচ্ছেন একচল্লিশের সুশীল। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। চাই অ্যাম্বুল্যান্স। সেই গাড়ি চেয়েই ফোন হাসপাতালকে। কিন্তু গাড়ি এল না। পরিবারের দাবি, হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল, অ্যাম্বুল্যান্স খারাপ হয়ে গিয়েছে। হাসপাতাল কর্তাদের দাবি, গাড়ি ভাড়া করে হাসপাতাল নিয়ে গেলে সেই টাকা দিয়ে দেওয়া হবে, বলা হয়েছিল। কিন্তু সে টাকাই বা কোথায় বন্ধ বাগানের শ্রমিকের? স্ত্রী পরে বলেছিলেন, ‘‘টাকা মিটিয়ে দেওয়ার কথা হয়েছিল নাকি? কই, আমরা তো জানি না।’’

তার পর অপেক্ষা করতে থাকল পরিবার। সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স আসবে না জানার পরে, জ্বর কমার অপেক্ষা। কখনও স্ত্রী, কখনও দুই মেয়ে সুশীলের কপালে হাত রেখে দেখতে লাগলেন, কপাল ঠান্ডা হবে কখন! ঘণ্টা দেড়েক পরে সবই যেন চিরস্থায়ী হিমশীতল হয়ে গেল। থেমে গেল শরীরের কাঁপুনি। চা সুন্দরী বাড়ির সামনে ভিড়। লোকে বলাবলি করল, “এত দুর্বল শরীর! খেত কী সুশীল?’’

উত্তরবঙ্গের বন্ধ চা বাগানএমন অনেক গল্প জানে। আতপ চালের ভাতের গল্প, কচু শাকের গল্প, চা ফুল ভাজার গল্প। বা বাগানখোলার গল্প।

২০১৯ সালে এক ফেব্রুয়ারির বিকেলে যেমন ময়নাগুড়ির চূড়াভান্ডারের মাঠ থেকে শোনা গিয়েছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হেলিকপ্টারে চেপে এসে উঁচু মঞ্চ থেকে, অনেক মাইকে তিনি বলেছিলেন, ডুয়ার্সের সব বন্ধ চা বাগান খুলে দিয়েছে দেশের সরকার। যা শুনে সেই সময়েও বন্ধ রেডব্যাঙ্ক, ঘরণীপুরের চা শ্রমিকেরা বলেছিলেন, “কই, আমরা তো জানি না!”

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tea Garden Workers Tea Garden Labourers tea gardens financial crisis Health Hazards

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।