ঘর বানাতে গিয়ে এ বার শ্রীঘর দর্শনের ভয় পাচ্ছে নির্মাণ শিল্প। সৌজন্যে সদ্য তৈরি হওয়া আবাসন আইন আর তা মেনে চলার পথ আটকে দাঁড়ানো সিন্ডিকেট। তাই সেই সিন্ডিকেট-সমস্যা সমূলে মেটাতে নতুন সরকারের সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনায় বসতে চায় তারা।
এ রাজ্যের নির্মাণ শিল্পের দাবি, সিন্ডিকেট-কাঁটা উপড়ে ফেলতে এ বার অন্তত কড়া হোক রাজ্য। নইলে ব্যবসা করাই কঠিন হবে নির্মাতাদের পক্ষে। কারণ, সময়ে প্রকল্প শেষ করা এবং তার গুণমান নিয়ে নতুন আবাসন আইন ভীষণ আঁটোসাটো। তাই তার উপর আবার সিন্ডিকেটের জুলুমও সহ্য করতে হলে লাভের মুখ দেখা কঠিন হবে। সঙ্গে জুটতে পারে হাজতবাসের যন্ত্রণা। একটি ছোট নির্মাণ সংস্থার কর্ণধার যেমন বলছিলেন, ‘‘নতুন আইন চালুর পরেও এই অবস্থা চলতে থাকলে, হয় হাজতবাস, নয়তো ব্যবসা গোটানো ছাড়া গতি নেই।’’
এই উদ্বেগ পাক খাচ্ছে বলেই রাজ্যে নতুন আবাসন আইন চালু হওয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চাইছে নির্মাণ শিল্প। শুধুমাত্র স্মারকলিপি পেশে আটকে না-থেকে আলোচনা চাইছে মুখোমুখি। যত দ্রুত সম্ভব। ঠিক যে ভাবে ২০১২ সালে নির্মাণ শিল্পে লগ্নি টানার লক্ষ্যে আয়োজিত ‘বেঙ্গল বিল্ডস’-এর মঞ্চে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন জাতীয় ও রাজ্য স্তরের নির্মাতারা। সে বার ওই মঞ্চ থেকেই সিন্ডিকেটকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ক্রেডাই-এর দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীকে সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে ওয়াকিবহাল রাখতে নিয়মিত ওই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে তাঁর সামনে সরাসরি তুলে ধরা যায় এই শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা।’’
সম্প্রতি সংসদে পাশ হয়েছে আবাসন বিল। তৈরি হয়েছে এই সংক্রান্ত নতুন আইনও। তার খুঁটিনাটি এখনও সামনে আসেনি। কিন্তু ওই বিলে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ‘সেল এগ্রিমেন্ট’-এর শর্ত মেনে নির্দিষ্ট সময়ে ফ্ল্যাটের চাবি ক্রেতার হাতে তুলে দিতে না পারলে, টাকা ফেরত দিতে হবে। সঙ্গে গুনতে হবে সুদ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা। ক্রেতা যদি টাকা ফেরত না নিয়ে প্রকল্প শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষায় রাজি থাকেন, তবুও প্রতি মাসে সুদ গুনে যেতে হবে প্রোমোটারকে। যত দিন না বাড়ির চাবি ক্রেতার হাতে যায়। এ জাতীয় সমস্যায় ক্রেতা হেনস্থার অভিযোগ দায়ের করলে এবং তা ঠিক প্রমাণিত হলে, তিন বছর পর্যন্ত জেলের ঘানি টানতে হতে পারে ডেভেলপারকে।
ঠিক এখানেই আশঙ্কার প্রথম সিঁদুরে মেঘ দেখছে নির্মাণ শিল্প। তাদের বক্তব্য, নতুন আইনে সময় মানার এই শর্ত পূরণের পথে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়াবে সিন্ডিকেট। কারণ, জমি কিনেই কাজ শুরুর রেওয়াজ বা রীতি এ রাজ্যে নেই। তার আগে কেনা জমির চার দিকে দেওয়াল তুলতে গেলেও ‘খুশি করতে হবে’ দাদাদের। ইঁট-বালি-পাথরকুচি কেনা থেকে শুরু করে ঠিকাদার ও কর্মী নিয়োগ— প্রায় প্রতি পায়ে দাবি মিটিয়ে যেতে হবে সিন্ডিকেটের। তাতে মুনাফা তো কমেই, অযথা নষ্ট হয় সময়ও।
শহরের এক নামী নির্মাণ সংস্থার কর্তার কথায়, ‘‘একেই এ জাতীয় উপদ্রবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে না পারলে, তা তৈরির খরচ বাড়ে। কমে মুনাফা। তার উপর যদি ওই কারণে সুদ বা জরিমানাও গুনতে হয়, তবে তো ব্যবসা করাই দায় হবে।’’ একই সঙ্গে নির্মাণ শিল্পের আশঙ্কা, জেলের ঘানি টানা নিয়েও।
নতুন আইনে কড়া শর্ত আরোপ করা হয়েছে ফ্ল্যাটের গুণমান সম্পর্কেও। বলা হয়েছে, বাড়ি ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে কোনও কাঠামোগত গলদ ধরা পড়লে, তা বিনা পয়সায় ঠিক করে দিতে হবে প্রোমোটারকে। অনির্দিষ্ট কাল ওই কাজ ফেলে রাখলে চলবে না। সেরে ফেলতে হবে ত্রুটি নজরে আনার তিরিশ দিনের মধ্যে। নইলে গুনতে হবে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ।
নির্মাণ শিল্পের অভিযোগ, রাজারহাট থেকে বাইপাস, বেহালা হোক বা বারুইপুর— প্রায় সর্বত্র বাড়ি বা ফ্ল্যাট বানাতে চড়া দামে বালি-পাথরের মতো ইমারতি জিনিস কিনতে হয় তাঁদের। এবং বেশি দাম গুনে সিন্ডিকেটের কাছে কেনা সেই কাঁচামালও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিম্নমানের হয়। তাঁদের প্রশ্ন, বাধ্য হয়ে খারাপ কাঁচামাল কিনে পাঁচ বছর নিখরচায় বাড়ি সারাইয়ের নিশ্চয়তা দেওয়া কী ভাবে সম্ভব?
এ প্রসঙ্গে সব থেকে সিঁটিয়ে আছে বিশেষত ছোট নির্মাণ সংস্থাগুলি। তাদের অভিযোগ, একে পুঁজি ও মুনাফার অঙ্ক অল্প। তার উপর সেই লাভের গুড় খেয়ে যায় সিন্ডিকেটের পিঁপড়ে। তাদের চোখ রাঙানিতে বাধ্য হয়ে আপোস করতে হয় চুন-বালি-সুরকির গুণমানের সঙ্গে। এক ছোট নির্মাতার আশঙ্কা, ‘‘এখন যদি বাধ্য হয়ে করা আপোসের কারণে মোটা দামও আমাদের চোকাতে হয়, তবে প্রকল্প তৈরিতে টাকা ঢালব কোন আশায়? কে বইবে ক্রেতার অভিযোগে জেলে যাওয়ার ঝুঁকি?’’
নির্মাণ শিল্পের আক্ষেপ, একেই এ রাজ্যে ফ্ল্যাট-বাড়ির চাহিদা তলানিতে। উপদেষ্টা সংস্থা কুশম্যান অ্যান্ড ওয়েকফিল্ডের হিসাব অনুযায়ী, ৩৩.২% অফিসের জায়গা খালি পড়ে রয়েছে। আবাসনেও চাহিদা কমেছে ৩০%। তার উপর এই শিল্পের গলায় কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে সিন্ডিকেটের গা-জোয়ারি। ক্রেডাই-এর যুব শাখার দাবি, আজকের হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে ঔজ্জ্বল্য এবং পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি একান্ত জরুরি। এই প্রজন্মের এক নির্মাতার প্রশ্ন, ‘‘জেলযাত্রায় তার কোনওটা হবে কি? সিন্ডিকেটের জুলুমের দায় আমরা বইব কেন?’’
এ বার বিধানসভা ভোট চলাকালীনও শাসক দলের এক নেতার মুখে শোনা গিয়েছে, সিন্ডিকেট থাকবেই। তিনি কার্যত দাবি করেছেন যে, তা দল ও সরকারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখন ভোটের বাদ্যি থামার পরে সেই অবস্থান বদলাবে বলে আশা করছে নির্মাণ শিল্প। সওয়াল করছে সিন্ডিকেট সামলে নতুন আইন মানা অসম্ভব বলে। আর সেই কারণেই নতুন সরকারের ‘নতুন’ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এখন আলোচনার টেবিলে বসার অপেক্ষায় তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy