রামকৃষ্ণ মঠ এবং মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী স্মরণানন্দ মহারাজ। — ফাইল চিত্র।
প্রায় ৭১ বছরের সঙ্ঘজীবন। যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপেই জায়গা করে নিয়েছিল, ‘শিব জ্ঞানে, জীব সেবা’। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের এই পরম উক্তিকে আত্মস্থ করে, আমৃত্যু মানুষের কথা ভেবেছেন যে মানুষটি, তিনি হলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্ঘাধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী স্মরণানন্দ। গত মঙ্গলবার রাতে রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে তাঁর মহাপ্রয়াণ অগণিত সাধু-ভক্তের হৃদয়ে এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করেছে।
সালটা ১৯৭৪। তখন স্বামী স্মরণানন্দ ছিলেন অদ্বৈত আশ্রমের কলকাতা শাখার ম্যানেজার। প্রতি রবিবার তিনি বেলুড় মঠে আসতেন। সেই সময় থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের শুরু। আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা, সরলতা, নিরভিমানতার মতো বিভিন্ন গুণের অধিকারী ছিলেন পরম পূজ্যপাদ মহারাজ। শুনেছি, ব্রহ্মচারী থাকার সময়ে তিনি মুম্বই আশ্রমে শ্রীশ্রী ঠাকুরের ভান্ডারের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তামিল ও ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনও ভাষা জানতেন না স্বামী স্মরণানন্দ। এ দিকে সেই সময়ে সেখানকার পূজারী মহারাজ বাংলা ছাড়া কিছু জানতেন না। ফলে পারস্পরিক কথাবার্তার আদানপ্রদানে ভুলের জন্য প্রায়ই বকুনি খেতেন স্মরণানন্দ মহারাজ। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব এমনই ছিল যে, ওই বকুনির জন্য কখনও মনে কিছু করতেন না। বরং সেই সময় থেকে তিনি বাংলা শিখতে শুরু করেন। এবং পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত যে, তাঁর সেই অধ্যবসায় কতটা দৃঢ় ছিল। কারণ, ঝরঝরে প্রচলিত বাংলায় বক্তৃতা করতেন মহারাজ। এমনকি, বেলুড়ে সারদাপীঠের সম্পাদক থাকার সময়ে তিনি ভাগবতের ক্লাসও নিতেন।
নতুন কোনও কিছু করার ভাবনা থেকে তিনি মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমের অনেক উন্নতিসাধন করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই সেখানে আপেল চাষ শুরু হয়েছিল। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে সাধুদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে বেরোতেন মহারাজ। তেমনই এক বিকেলে বেরিয়ে বাঘের দেখা পেয়ে অন্য পথে আশ্রমে ফিরে এসেছিলেন। স্বামী স্মরণানন্দের ব্যক্তিত্বের সব থেকে আকর্ষণীয় দিক ছিল, সকলকে অতি সহজে নিজের কাছে টেনে নিতে পারতেন। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মের সার্ধশতবর্ষে তাঁর জীবনীর উপরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থাপক ছিলেন স্বামী স্মরণানন্দ। পাশাপাশি তিনি প্রকাশিত বইয়ের প্রুফ দেখতেন। সেই সময়ে নবম সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী মাধবানন্দজির ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদের শাঙ্কর ভাষ্য’-র ইংরেজি অনুবাদের নতুন সংস্করণ প্রকাশের তোড়জোড় চলছে। এক দিন প্রুফ দেখতে গিয়ে স্মরণানন্দ মহারাজের মনে হল, একটি জায়গায় অনুবাদ ঠিকমতো হয়নি। বিষয়টি তিনি জানতে চাইলেন যিনি মায়াবতীর তৎকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন, তাঁর কাছে। কিন্তু তিনি কোনও কিছু বলতে পারলেন না। বরং স্মরণানন্দ মহারাজকে বলা হয়েছিল, তাঁর সংশয়টি নিয়ে সরাসরি মাধবানন্দজিকেই জিজ্ঞাসা করতে। সেই সময়ে খুবই অসুস্থ মাধবানন্দজি তখন সেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাধীন।
তাঁর কাছে গিয়ে অনুবাদ নিয়ে সংশয়টি ব্যক্ত করলেন স্বামী স্মরণানন্দ। কিন্তু মাধবানন্দজি যখন তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন, কেন তিনি এমন অনুবাদ করেছেন, তা শুনে মেনে নিলেন স্মরণানন্দ মহারাজ। আসলে তিনি যেমন সাহসী ছিলেন, তেমনই তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিও ছিল বেশি। যে কোনও পরিস্থিতির সঙ্গেই তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন। বাচ্চাদের জন্য শ্রীশ্রী ঠাকুর-মা-স্বামীজির উপরে ইংরেজি ভাষায় যে বইগুলি রয়েছে, তাতে শিল্পী বিশ্বরঞ্জন চক্রবর্তীর আঁকা ছবির ব্যবহার প্রথম করেছিলেন স্বামী স্মরণানন্দ।
সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও যে তরুণেরা পারিবারিক ও শারীরিক কারণে যোগ দিতে পারতেন না, তাঁদের জন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিল স্মরণানন্দ মহারাজের। এক দিন অবিবাহিত যুবক নবনিহরণ মুখোপাধ্যায়কে ডেকে বললেন, খাপছাড়া কাজ করে কোনও লাভ নেই। বরং প্রয়োজন সমষ্টিগত কাজের। সেই লক্ষ্যে দেশব্যাপী অখিল ভারতীয় যুব মহা মণ্ডল তৈরি করেন স্বামী স্মরণানন্দ। সেখানে ক্রমশ সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করায় প্রতি বছর ডিসেম্বরে এক সপ্তাহের জন্য যুব মহা মণ্ডলের আবাসিক শিবির চালু করেন তিনি। শিল্পমন্দিরে আয়োজিত হত সেই শিবির। সেখানে অংশ নিতেন প্রবীণ সন্ন্যাসীরাও। এ থেকেই স্মরণানন্দ মহারাজের সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় মেলে।
গান ভালবাসতেন মহারাজ। সারদাপীঠে থাকার সময়ে গান জানা অন্য সাধুদের নিয়ে কালী কীর্তন গাইতেন। সেই সময়ে সর্বগানন্দ মহারাজও সারদাপীঠে ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ওই কালী কীর্তন রেকর্ড করে ক্যাসেট বার করে বিক্রির পুরো ব্যবস্থা করেন স্মরণানন্দ মহারাজ। সেই সাফল্যের পরে কথামৃতের গান, শ্রীশ্রী চণ্ডীও রেকর্ড করান মহারাজ। আজও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিটি কেন্দ্রে সন্ধ্যায় আরতির সময়ে যে ‘খণ্ডন ভব...’ গানটি গাওয়া হয়, সেটি প্রথম রেকর্ড করে মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কান্ডারিও ছিলেন স্মরণানন্দজি।
১৯৮০-তে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় মহাসম্মেলনে তাঁর উপরে ভার ছিল রামকৃষ্ণ আন্দোলন নিয়ে প্রদর্শনী করার। তাতে তাঁর শিল্পী মনের পরিচয় মেলে। ১৯৮৫-র ডিসেম্বরে সর্বভারতীয় যুব মহাসম্মেলন হল। সেই সময়ে একদল যুবক মনস্থির করলেন, তাঁরা গ্রামে গিয়ে কাজ করবেন। ইচ্ছের কথা আমাকে জানালে, হুগলির খানপুরে গিয়ে ওঁদের স্বাস্থ্য শিবির করার পরামর্শ দিলাম। ক্রমশ সেই কাজের ব্যাপ্তি বাড়তে লাগল। তখন আমার পরামর্শে ওই যুবকেরা বিষয়টি গিয়ে জানালেন স্মরণানন্দজিকে। সব শোনার পরে চিকিৎসক গৌর দাসের নেতৃত্বে বিবেকানন্দ স্বাস্থ্য সেবা সঙ্ঘ তৈরি করলেন মহারাজ। ত্রাণ কাজেও তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তিনি মানুষের কষ্টকে অনুভব করে তা লাঘবের পরিকল্পনা করতেন। ছিলেন অত্যন্ত প্রকৃতিপ্রেমী। একদমই গাছ কাটা পছন্দ করতেন না।
মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা স্মরণানন্দজি কখনও নিজের শরীরের কথা ভাবতেন না। সঙ্ঘের সহকারী সম্পাদক হওয়ার পরেও ব্যস্ততা সামলে তাঁর সমস্ত কাজ করে যেতেন নিঁখুত ভাবে। সেই সময়ে সাধুদের নৈশ ক্লাসে গিয়ে তিনি মজার চুটকি বলে সকলকে আনন্দ দিতেন, যাতে প্রত্যেকের সারা দিনের ক্লান্তি দূর হওয়ার পাশাপাশি পারস্পরিক আত্মিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। একই রকম ভাবে দীর্ঘ সময় তিনি সামলেছেন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। ২০১৭-তে সঙ্ঘাধ্যক্ষের পদে বসার পরেও তিনি ছিলেন পুরো অন্য মানুষ, যিনি সকলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে দ্বিধা বোধ করতেন না। কখনও দেখা যেত না ক্লান্তির ছাপ। নিজস্ব সরলতা দিয়ে সকলকে আপন করে নেওয়ার শক্তিধারী পরমপূজ্যপাদ স্বামী স্মরণানন্দজির স্মৃতি-আদর্শ আগামীর পাথেয় হয়ে থাকবে।
স্বামী বিমলাত্মানন্দ
অধ্যক্ষ, কাঁকুড়গাছি, যোগোদ্যান মঠ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy