গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
স্পষ্ট উচ্চারণে এক নিশ্বাসে রায় পড়ে শোনাচ্ছিলেন বিচারক। আদালতকক্ষে তখন আলপিন পতনের নিস্তব্ধতা। হঠাৎ ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ! কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলেন বিচারকও। তার পর আবার পড়তে শুরু করলেন। শোনালেন ফাঁসির সাজা। বিচারকের সাজা ঘোষণা শেষ হতেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না অপরাধী। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ভিড়ের মধ্যে খুঁজতে লাগলেন পরিজনের মুখ। ঠিক সেই সময়েই এজলাসে শোনা গেল আরও একটি তীব্র আর্তনাদ। ‘সুতপা... সুতপা মা...’ বলে চিৎকার করে উঠলেন মুর্শিদাবাদের বহরমপুরকাণ্ডে নিহত তরুণীর বাবা স্বাধীন চৌধুরী।
প্রাক্তন প্রেমিকা সুতপা চৌধুরীকে কুপিয়ে খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া সেই ‘প্রেমিক’ সুশান্ত চৌধুরীকে বৃহস্পতিবার ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন বহরমপুরের দ্রুত নিষ্পত্তি আদালতের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সন্তোষকুমার পাঠক। এই রায়ের পরে কাঁদতে কাঁদতে আদালত চত্বর ছাড়েন সুশান্ত। ধরা গলায় তাঁর উক্তি, ‘‘সহানুভূতির খেলা হল। ন্যায়বিচার হল না।’’
২০২২ সালের ২ মে বহরমপুর গার্লস কলেজের প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্রী সুতপা ভরসন্ধ্যায় বহরমপুরেরই গোরাবাজারে একটি মেসের সামনে খুন হন। বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে ফেরার পথে মেসে ঢোকার সময় তাঁর উপরে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন সুশান্ত। এলোপাথাড়ি কোপে ক্ষতবিক্ষত করেন সুতপার শরীর। সেই হাড়হিম করা দৃশ্য দেখে স্থানীয়েরা এগিয়ে এলেও সুতপাকে বাঁচানোর সাহস কেউ দেখাননি। কারণ, তত ক্ষণে হাতে থাকা ‘পিস্তল’ উঁচিয়ে ধরেছেন সুশান্ত। এর পরেই মেসের পাঁচিল টপকে পালিয়ে যান যুবক। পরে পোশাক বদলে সেখান থেকে গা ঢাকা দেন তিনি। কিন্তু খুনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শমসেরগঞ্জের কাছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে গ্রেফতার করা হয় সুশান্তকে। পরে আদালতে খুনের কথা কবুলও করেন তিনি। ঘটনার ৭৫ দিনের মাথায় বহরমপুর আদালতে চার্জশিট পেশ করে পুলিশ। সুশান্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় (খুন), ২০১ ধারায় সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট, ২৮এ ধারায় অস্ত্র আইনে অভিযুক্ত করা হয়। এর পর শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। হত্যাকাণ্ডের ১৫ মাস পরে গত মঙ্গলবার সুশান্তকে দোষী সাব্যস্ত করল আদালত।
সাজা ঘোষণার পর আদালতের বাইরে বেরিয়ে সুতপার বাবা স্বাধীন বলেন, ‘‘আমার মেয়ের আত্মা আজ শান্তি পাবে। এই ধরনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড না হলে আবার অন্য কারও সঙ্গে ঘটতে পারত।’’ সুতপার মা পাপড়ি চৌধুরী অবশ্য এই রায়ে ততটাও খুশি নন। মেয়ের খুনিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে— এই খবর পাওয়া মাত্রই মালদহের ইংরেজবাজারের বাড়িতে বসে কেঁদে ফেলেন তিনি। ধরা গলায় বলেন, ‘‘শুধু ফাঁসিতে কী হবে! ফাঁসি অনেক কম শাস্তি।’’ পাশাপাশি, পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেন পাপড়ি। কুর্নিশ জানান বিচারব্যবস্থাকেও। সুতপার মা বলেন, ‘‘এক বছরের মধ্যেই বিচার হয়েছে। কিন্তু এই দুঃখ সারা জীবনেও মিটবে না। চাকরি করার ইচ্ছে ছিল মেয়ের। কোনও দিন মিটবে না এই যন্ত্রণা।’’
অন্য দিকে, সুশান্তের ফাঁসির সাজা শুনে আদালত চত্বরে মূর্ছা যান তার মামা রমেশ চৌধুরী। তড়িঘড়ি তাঁকে উদ্ধার করে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রা কমে যাওয়ায় ও উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। বেডে শুয়ে বারবার ‘সুশান্ত... সুশান্ত....’ বলে কেঁদেও উঠছেন বলে জানা গিয়েছে হাসপাতাল সূত্রে। সংজ্ঞা হারিয়েছেন সুশান্তের পিসি শান্তিরানি চৌধুরীও।
কী ভাবে এগোল তদন্ত
সুতপাকে খুন করে সুশান্তকে পালিয়ে যেতে দেখেছিলেন দুই প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁদের বয়ান রেকর্ডের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তদন্তের প্রাথমিক পর্ব। খতিয়ে দেখা হয় সিসিটিভি। যে মোবাইলে এই ঘটনা দৃশ্যবন্দি হয়েছিল, সেটিও খতিয়ে দেখে পুলিশ। সুশান্তের বিরুদ্ধে বহরমপুর থানায় খুনের লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সুতপার বাবা স্বাধীন। উদ্ধার করা হয় ঘটনার সময় ভয় দেখাতে ব্যবহার করা পিস্তলটি। পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেটি একটি খেলনা পিস্তল। একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে ঘটনার কয়েক দিন আগে সেটি কিনেছিলেন সুশান্ত। বয়ান রেকর্ডের জন্য ডাকা হয় ই-কমার্স সংস্থার প্রতিনিধিকে। যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে সুতপাকে খুন করা হয়েছিল, সেটি বহরমপুরের প্রাঙ্গণ মার্কেট এলাকার একটি দোকান থেকে কেনা হয়। সেই দোকান মালিক ও কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সুতপা যে মেসে থাকতেন, সেই মেসের মালিককেও তদন্তের আওতায় আনে পুলিশ।
কী ভাবে এগোল বিচারপ্রক্রিয়া
দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বহরমপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলাটি স্থানান্তর করা হয়। এই মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী হিসাবে সওয়াল করেন বিভাস চট্টোপাধ্যায়। সুশান্তের আইনজীবী হিসাবে লড়েন পীযূষ ঘোষ। ময়নাতদন্ত যিনি করেছিলেন সেই চিকিৎসক আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে জানান, সুতপার দেহে মোট ৪২টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। আঘাত গুরুতর হওয়ায় রক্তক্ষরণের জন্য মৃত্যু হয়েছিল সুতপার। শুনানি চলাকালীন মোট ৩৪ জনের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করে আদালত। ইলেকট্রনিক্স তথ্যপ্রমাণ হিসাবে একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ, মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ভিডিয়ো ফুটেজ, মোবাইল টাওয়ার লোকেশন, কল রেকর্ড, হোয়াট্সঅ্যাপ চ্যাট গ্রহণ করা হয়। মাত্র ১৫ মাসের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে আদালত। সরকার পক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দেন মৃতার বাবা-সহ দুই প্রত্যক্ষদর্শী, এক সাংবাদিক, ই-কমার্স সংস্থার প্রতিনিধি, দুই ব্যবসায়ী, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক, সুতপাকে মৃত ঘোষণা করা চিকিৎসক, পুলিশ এবং আরও অনেকে। প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে বান্টি ইসলাম সেই দিনের ঘটনার নৃশংসতা আদালতকক্ষে বর্ণনা করেন। চলতি মাসের ২৯ অগস্ট আদালত উভয় পক্ষের সওয়াল-জবাব শোনার পর সুশান্তকে ৩০২, ২০১, ২৮এ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে। বুধবার অর্থাৎ ৩০ অগস্ট সরকার পক্ষের আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় বহরমপুরের ছাত্রী খুনের ঘটনাকে ‘বিরলতম’ আখ্যা দিয়ে সুশান্তের মৃত্যুদণ্ডের আবেদন জানান। অন্য দিকে, পুরনো শত্রুতার বশে নয়, বরং ভালবাসায় প্রতারিত হয়েই খুন— এই যুক্তি দেখিয়ে সুশান্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রার্থনা করেন তাঁর আইনজীবী। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার বহরমপুরের তৃতীয় ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের অতিরিক্ত ও জেলা দায়রা বিচারক সন্তোষকুমার পাঠক সুশান্তকে ফাঁসির সাজা শোনান।
কী বললেন দু’পক্ষের আইনজীবী
সরকার পক্ষের আইনজীবী বিভাস এই রায় প্রসঙ্গে বলেন, “আধুনিক সমাজে এক জন মহিলা যদি মনে করেন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবেন, তবে সেটি করার অধিকার তাঁর আছে। সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গেলে প্রেমিকাকে খুন করার অধিকার জন্মায় না। প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্ক থাকল না বলে অন্য কারও সঙ্গে তাঁকে থাকতে দেব না, এটা সত্যিই বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা।” তিনি জানান, আদালতের কাছে মৃত্যুদণ্ডই প্রার্থনা করা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গেই তাঁর সংযোজন, “এলোপাথাড়ি কোপাতে গিয়ে সুশান্তের নিজের হাত কেটে যায়, তার পরেও থামেননি। একটি অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে গান টয় কেনেন এবং যারা মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়েছিল, তাঁদেরকেও ভয় দেখানো হয়। সুতপার মৃত্যুকে নিশ্চিত করার জন্য ওই খেলনা বন্দুক নিয়ে ঘটনাস্থলে যান সুশান্ত। সমস্ত কিছু বিবেচনা করে আমাদের মনে হয়েছে এটা বিরলতম ঘটনা।” অন্য দিকে, সুশান্তের আইনজীবী পীযূষ ঘোষ বলেন, ‘‘আমার মক্কেল এক জন মেধাবী ছাত্র। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অন্তত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রার্থনা করেছিলাম। মহামান্য আদালত তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়েছে। রায়ের কপি পাওয়ার পর মক্কেলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’
কী বক্তব্য সুশান্তের পরিবারের
সুতপার পরিবারের প্রতি একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সুশান্তের কাকিমা পুতুল চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘মেয়ের মতো বাবাও নাটক করেই গেল। ওদের টাকাপয়সা আর নাটকের কাছে আমাদের হার হল। সুশান্তকে মেরে যদি ওদের শান্তি হয়, তাই হোক।’’ ছোটবেলায় সুশান্তকে হাতে করে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতেন পিসি শান্তিরানি চৌধুরী। ভাইপোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে শুনে জ্ঞান হারিয়েছেন সেই পিসিও। আদি বাড়ি মহিষবাথানির খনিবাথানি এলাকায় হলেও ছোট থেকেই পিসির মালদহের ইংরেজবাজারের বাড়িতেই থাকতেন সুশান্ত। সেখানে থেকেই পড়াশোনা। ইংরেজবাজার থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে তাঁর গ্রামের বাড়ির সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ ছিল না তাঁর। বরং, পিসি ও মামাদের অত্যন্ত ‘আদুরে’ ছিলেন ‘একরোখা’ সুশান্ত। পরিবার সূত্রে খবর, জ্ঞান ফেরার পর থেকে বিড়বিড় করছেন শান্তিরানি। বারেবারে বলছেন— ‘‘কেন করলি বাবা? মেয়ে কি আর ছিল না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy