সুপ্রিম কোর্টে অভিষেক-জুটির কারণেই কলকাতা হাই কোর্টে নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা থেকে সরতে হচ্ছে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে! নিজস্ব চিত্র।
এক অভিষেক মামলা করেছিলেন। তাঁর হয়ে সওয়াল করলেন আর এক অভিষেক। সুপ্রিম কোর্টে এই অভিষেক-জুটির কারণেই কলকাতা হাই কোর্টে নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা থেকে সরতে হচ্ছে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে!
সম্প্রতি স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির মামলার একটি নির্দেশনামায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ ছিল, প্রয়োজনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে সিবিআই ও ইডি। সেই পর্যবেক্ষণকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন অভিষেক। তাঁর হয়ে সওয়াল করলেন আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। যিনি কংগ্রেসের রাজ্যসভা সাংসদ। তাঁর অভিযোগ ছিল, নিয়োগ মামলার সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক না থাকলেও সিবিআই-ইডিকে কার্যত তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। হাই কোর্ট তাঁকে ‘ভিত্তিহীন ভাবে দোষারোপ’ করেছে। অভিষেকের করা সেই মামলাতেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়োগ মামলা থেকে সরানোর নির্দেশ দিল দেশের শীর্ষ আদালত।
এই প্রসঙ্গেই সিঙ্ঘভির আরও অভিযোগ ছিল, সেপ্টেম্বরে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারেও তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে জড়িয়ে কথা বললে অভিষেকের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তিনি। তৃণমূল সাংসদ অভিষেক প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এ-ও বলেছিলেন, ‘‘উনি কিচ্ছু করতে পারবেন না। আমাকে হয়তো মেরে ফেলতে পারেন। তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’’ ভরা এজলাসে সিঙ্ঘভি বলেছিলেন, ‘‘সম্মান রেখেই বলছি, এটা হতে পারে না। একক বিচারপতি তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যাও দেননি, প্রত্যাহারও করেননি।’’
স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের একাধিক নির্দেশেই ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছে বা নির্দেশ কার্যকর না করার কথাও বলেছে। এই প্রেক্ষাপটে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এবিপি আনন্দ-কে দেওয়া সাক্ষাৎকার নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন খোদ শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। সিঙ্ঘভির সওয়ালের প্রায় চমকে উঠে বিচারপতি চন্দ্রচূড় প্রশ্ন করেছিলেন, উনি কি এক জন কর্মরত বিচারপতি? এর পর প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় কলকাতা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এবিপি আনন্দের সুমন দে-কে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কি না, তা তিনি যেন ব্যক্তিগত ভাবে বিচারপতির থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করে সুপ্রিম কোর্টকে জানান।
তার পর বিচারপতি চন্দ্রচূড় জানিয়ে দেন, এক জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিজের মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বিচারপতি যা করেছেন, তা সঠিক পন্থা হতে পারে না। প্রধান বিচারপতির তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য ছিল, ‘‘বিচারপতিরা কোনও ভাবেই তাঁদের বিচারাধীন বিষয় নিয়ে টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে পারেন না। উনি যদি সাক্ষাৎকার দিয়ে থাকেন, তা হলে তিনি ওই মামলা শোনার অধিকার হারিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে নতুন কোনও বিচারপতিকে দায়িত্ব দিতে হবে।’’ বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের এই মন্তব্যের সূত্রেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আগামী দিনে স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির মামলা আদৌ আর শুনতে পারবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল বিভিন্ন মহলে। শুক্রবার সেই জল্পনার অবসান হল।
বিচারপতির চন্দ্রচূড়ের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এজলাসে বসে বলেছিলেন, ‘‘আমি যখন সাক্ষাৎকার দিয়েছি, তখন তার উত্তর আমাকেই দিতে হবে।’’ প্রসঙ্গত, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, বেঙ্গালুরু প্রোটোকল (পোশাকি নাম দ্য বেঙ্গালুরু প্রিন্সিপলস অব জুডিশিয়াল কনডাক্ট) মেনেই তিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। বস্তুত, বিচারক এবং বিচারপতিরা কী কী করতে পারেন, তা ওই নীতিমালায় বলা আছে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, আদালতের পবিত্রতা, নিরপেক্ষতা এবং স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বিচারক এবং বিচারপতিরা সামাজিক অনুষ্ঠান, সমাবেশে যোগ দিতে পারেন। এমনকি মতও প্রকাশ করতে পারেন।
সম্প্রতি শহিদ মিনারের জনসভা থেকে অভিষেক অভিযোগ তুলেছিলেন, সিবিআই তাঁর নাম বলানোর জন্য মদন মিত্র, কুণাল ঘোষকে চাপ দিয়েছিল। এর পরেই নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত কুন্তল ঘোষ (তৃণমূলের বহিষ্কৃত, জেলবন্দি যুব নেতা) হেস্টিংস থানায় চিঠি লিখে অভিযোগ করেন, সিবিআই-ইডি তাঁকে অভিষেকের নাম বলানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। তার প্রেক্ষিতে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ১৩ এপ্রিল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, অভিষেকের বক্তৃতার সঙ্গে কুন্তলের চিঠির কোনও যোগ আছে কি না, তা তদন্ত করে দেখতে হবে। নির্দেশনামায় বিচারপতি জানান, অভিষেক এবং কুন্তল দু’জনকেই ইডি ও সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করেই সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন অভিষেক।
সেই মামলার শুনানির সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সম্পর্কে নিজের এজলাসে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় কী বলেছেন, তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণও করেছিলেন সিঙ্ঘভি। তাঁর অভিযোগ ছিল, সুপ্রিম কোর্ট তাঁর নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেওয়ায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বলে যা ইচ্ছে করা যায়? জমিদারি নাকি? সিঙ্ঘভি মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘এটা অভূতপূর্ব। আইনজীবীদের উপস্থিতিতে এই মন্তব্য করা হয়েছে।’’ এর পরেই অভিষেক সম্পর্কে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় কী বলেছেন, সে দিকে বিচারপতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সিঙ্ঘভি। জানান, নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় অভিষেকের বিরুদ্ধে কিছু না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি বিচারাধীন বিষয়ে বিচারপতির সাক্ষাৎকার দেওয়া নিয়ে ‘কড়া অবস্থানের’ কথা বলেন। শুক্রবার সেই মামলাতেই হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের জমা দেওয়া হলফনামা বিচার করে নিয়োগ মামলা থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে সরানোর নির্দেশ দিল শীর্ষ আদালত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy