একটা সময় পর্যন্ত ঝর্না কলম (ফাউন্টেন পেন)-এর কথা মুখে এলেই সুলেখার কথা মনে পড়ত। —ফাইল চিত্র।
‘স্বদেশি শিল্পই জাতির মেরুদণ্ড। স্বাধীন ভারতে বিদেশি কারখানা ক্ষতিকর।’ স্বাধীনতা পূর্ব ভারতে এমনই ছিল সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনী স্লোগান। পরবর্তী সময়ে নিজের ‘ভারতের গৌরব’ বলেই দাবি করে এসেছে কলকাতার সংস্থা সুলেখা কালি।
একটা সময় পর্যন্ত ঝর্না কলম (ফাউন্টেন পেন)-এর কথা মুখে এলেই সুলেখার কথা মনে পড়ত। আজ সেই দিন নেই। আরও নানা উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে টিকে থাকার রসদ খুঁজতে হয় সুলেখাকে। কিন্তু কালি থেকে সরে আসেনি। এখন নতুন করে সেই কালিকে নতুন করে ক্রেতার কাছে ধরে নিয়ে অন্যতম মাধ্যম ‘দেশপ্রেম’। সংস্থার বর্তমান কর্ণধার কৌশিক মৈত্রর কথায়, ‘‘মোড়কটাই নতুন। পুরনো গুণমান বজায় রেখেই আমার বাজারে আছি। বিপণনের মোড়কটা শুধু বদলেছে।’’
কেমন সেই বদল? ‘স্বদেশি’, ‘স্বরাজ’ আর ‘স্বাধীন’। এই তিন নামেও সাবেক মোড়কে মিলছে সুলেখা কালি। ‘স্বদেশি’-তে তিনটি, ‘স্বরাজ’-এ দশটি ও ‘স্বাধীন’-এ দু’টি রঙের কালি পাওয়া যাচ্ছে। আরও একটা বড় বদল এসেছে। সুদৃশ্য বটুয়ায় থাকছে কালির দোয়াত, সঙ্গে সুলেখা কালির গৌরবময় ইতিহাস এবং সেকালের বিজ্ঞাপন-খোদিত স্মারক। নতুন দিনের দাবি মেনে ক্রেতাদের জন্য ‘হোম ডেলিভারি’-র ব্যবস্থাও রয়েছে।
এই কালির ইতিহাসের সঙ্গে স্বাধীনতার ইতিহাস আর স্বদেশি প্রতিষ্ঠান তৈরির ইতিহাস জড়িয়ে। ‘সু’ মানে ভাল লেখা যায় বলে মহাত্মা গাঁধী নাম রেখেছিলেন ‘সুলেখা’। বিভিন্ন সময় এই কালির প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর সত্যজিৎ রায় তো বারবার সুলেখা কালির কথা লিখেছেন তাঁর ‘ফেলুদা’ কাহিনিতে। এমনকি সত্যজিতের ছবিতেও দেখা গিয়েছে সুলেখার দোয়াত।
কালির ফর্মুলা মৈত্রদের হাতে আসার পিছনেও রয়েছে এক ইতিহাস। ১৯৩২ সালে গাঁধীজি একটা স্বদেশী কালি তৈরির আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তখন বেঙ্গল কেমিক্যালসের প্রাক্তন কেমিস্ট সতীষচন্দ্র দাশগুপ্তর কাছে। কৃষ্ণধারা নামে সেই কালি তখন খাদির দোকানে বিক্রি হত। পরে সেই কালির ফর্মুলাই আসে সুলেখার হাতে। একটা সময় কলকাতার পাশাপাশি অধুনা বাংলাদেসের রাজশাহীতেও ছিল উৎপাদন কেন্দ্র। এখন যে যাদবপুরে ‘সুলেখা মোড়’ রয়েছে সেখানে কারখানা যাওয়ার আগে আরও কয়েক জায়গায় ছিল উৎপাদন ও বিপণন কেন্দ্র। স্বাধীনতার পরে উত্তর ২৪ পরগনার সোদপুরে তৈরি হয় অনেক বড় আকারের কারখানা। একটা সময় কালি বিক্রিতে ভারতের এক নম্বর সংস্থা পরে অবশ্য অনেক ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। তবে দীর্ঘদিন দেশের বাইরের বাজারেও ছিল সুলেখার চাহিদা। কেনিয়ায় নিজস্ব কারাখানাও তৈরি হয়।
তবে সে সব অনেক পরের কথা, যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বদেশি আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবেই। মহাত্মা গাঁধীর পরামর্শে ১৯৩৪-এ ‘সুলেখা’ কালির যাত্রা শুরু। লক্ষ্য ছিল, স্বদেশি কালি দিয়ে বিদেশি কালিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা। কিন্তু ঝর্না কলমের ব্যবহার কমতে থাকা-সহ নানা কারণ, আটের দশকে সঙ্কটে পড়ে সুলেখা।
১৯৮৮ সাল থেকে দীর্ঘ কাল বন্ধ ছিল কারখানা, খোলে ২০০৬-এর শেষে। তার পর উৎপাদন চালু হলেও সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই কালি বাজার থেকে সরতে থাকে। প্রায়-বিস্মৃতিতে যেতে বসা সেই কালিকে আদি মোড়কে ফিরিয়ে আনার দাবি উঠতে শুরু করলে তাতেই সাড়া দেন সুলেখা কর্তৃপক্ষ। তাতেই নয়া সংযোজন— এক বটুয়া ‘সুলেখা’, থুড়ি ‘স্বাধীনতা’। সুলেখার কর্ণধার কৌশিক জানিয়েছেন, আগ্রহীরা সুলেখার ওয়েবসাইটে গেলেই বিস্তারিত জানতে পারবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy